ঠিক থুতনিতে টলটল করছিল জলের ফোঁটা। পড়তে গিয়েও আলস্যে বা আল্হাদে আটকে আছে। চূর্ণ চূর্ণ জলকণা চুলে। চোখের পাতায়। পল্লবের ঠিক বিন্দু-প্রান্তে। জল ঠিক নেমে যাবে গড়িয়ে গড়িয়ে গোপনে গভীরে। যায় আরো গভীরে যায় । খুব ধীর তার চলন।তোরঙ্গের পুরোনো সম্পদে জলছাপ। কুলুঙ্গির ঠাকুর-পট, দেরাজের বেনারসি পাট, পাটে ও পটে জলকথামালা। পিছু ফিরে তাকালেই জলচ্ছ্বাসের কোলাহল। ধূপ দিতে দিতে পাঁচালীর ছন্দে ছন্দে ঝরঝর ঝরঝর বৃষ্টি পতনের শব্দ। শব্দে শব্দে জল বাড়ে। বাড়ে। তখনই উচ্ছাসে ঝাপান আহ্বান এসে দরজা হাঁটকায়। খোলো খোলো দরজা খোলো...খোলো জানালা হাট। ভেঙ্গে ফেলে প্লাবন। উথাল পাতাল। ভেজা, ভেজা কেউ পড়ে থাকে ছড়িয়ে আঁচল, আগোছালো চুল, গল্পমালা, কবিতাকল্পলতা। বারিপ্রেমমালা ছড়ায় দিকবিদিক। জলের ছলাৎ ছলাৎ এর মধ্যে পড়ে থাকে কেউ কবিতার মতো সবুজ হ'য়ে পথে-মাঠে-ঘাটে-উঠানে...
তাকে তুমি চেনো? সাক্ষাত হয়েছে কোনো?
বলে তাকাল বৃষ্টি । ভারি মেঘের মতো তার দৃষ্টি । যে দৃষ্টিতে মৃত্যু লেখা আছে।
ঠিক থুতনিতে টলটল করছিলো জলের ফোঁটা। জলবিন্দুর কোন কবিতা উচ্ছাস নেই। কারন তার অবস্থানে সেই মুখ নেই, মুখের প্রেক্ষাপট নেই, যে মুখমন্ডলের ঢালে এখন সে আটকে আছে। প্রেক্ষাপটেরও কোন গল্প নেই। নেই কল্পগাথা। ভেসে যাবার আখ্যান। কিন্তু তার গড়িয়ে যাওয়া আছে। টুপ। পড়বে সে। পড়েই তো তার সমাপ্তি নেই। সে গড়াবে। ভেজাতে ভেজাতে গড়াবে। নিঃস্ব না হওয়া পর্যন্ত, সে গড়াবে। জানা নেই। ঠান্ডা শব্দহীন তার চলা। গভীরে গোপনে গোপনে সে গড়িয়ে পড়বে নির্মোহ। কিন্তু কী অপার মোহ জড়াবে ওএই ছড়াবে জীবনপথে। আর ভিজিয়ে ভিজিয়ে পুলক ছড়াবে, পুলকে পুলকে দুলে উঠবে প্রকৃতি। কবিতা গান কুলুকুলু তারই ছন্দে ছন্দে শরীরে জেগে উঠবে অনন্তগীতি। ছড়াবে কবিতামালা। সে কী জানে? কার, কোথায় নিভৃত কোনে বিষাদে হরসে গোপনে রাখা তোরঙ্গে ভাঁজ করা রুমালটি'র কথা!কুলঙ্গিতে মাটির জমানো ঘট, ঘটের আখ্যান, জানে সে! জাগিয়ে তুলছে নীরবে 'ভালো থেকো' সিল্কের রঙিন সুতোয় বোনা মেঘলা দুপুরের গান। কে কোথায় কোন ছবি বাঁধিয়ে রেখেছে কোন দেওয়ালে!!
বৃষ্টি খিলখিল, আমার একটা ছবি তুলে দেবে!
ছবি তুলতে গেলেই পাল্টে যাচ্ছে গতি, চলন, ডৌল, গড়ন এমন কি রঙও...
খিলখিল বৃষ্টি গড়িয়ে পড়ল কোলে। দামাল মেঘচুল ঢেকে ফেলল। খুব শান্ত শীতল অথচ দৃঢ় ধীর বাতাস শরীরের তন্ত্রে তন্ত্রে । আমি ধীরে, অতি ধীরে বৃক্ষ হয়ে উঠছি। ঝম ঝম নেমে আসে প্রেম। প্রবল লাস্যে ও আশ্লেষে ছড়িয়ে পরে বৃষ্টি । পাতা কেঁপে ওঠে। মাটি থিরথির। নদীর লজ্জা নিয়ে কূলের গাছ নুয়ে পড়ে। এই সকল সকল কিছু ঘটতে থাকে যখন, ঠিক তখনই পুরানো তোরঙ্গ থেকে নীলখামে- প্রিয়তমা, তোমাকে দিলাম এক মেঘ বৃষ্টি এনে...উড়ে উড়ে দিকবিদিক।
ঠিক থুতনিতে টলটল জলবিন্দু। আলস্য আমরা বলেছি। আল্হাদ আমরা ভাবছি। তার মুখ ও খোলাচুলের প্রেক্ষাপট আমাদেরই দান। বৃষ্টি? তোমার গড়িয়ে পড়ার ছন্দকে সুন্দর করেছে আমাদের চর্চিত অবসরের সকল কবিতা ও গান। আসলে তুমি কেমন তারই ব্যার্থ চিৎকার, নিভৃত কান্না, অক্ষম বর্ণনায় তিন হাজার মাইলের সভ্যতার পরেও এই হেঁটে চলা, এই খুঁজে চলা বৃষ্টির ভেতরে বৃষ্টি হওয়ার গল্প, এই বলার, এই এই তুলির ডগায় তুলে নেওয়া অর্বাচিন রঙ, তোমায় তোমাকে ধরার নানা ছল। ছলাৎ ছলাৎ, কী বলবি বল!!
খিলখিল হেঁসে ওঠে বৃষ্টি
বিন্দু বিন্দু গান ঝরে পড়ে ....
"তোমারই তুলনা তুমি প্রাণ
এ মোহে মন্ডলে..."