চিন ভারত বর্তমান সঙ্কট প্রাসঙ্গিক কিছু কথা - কুনাল চট্টোপাধ্যায়

চিন-ভারত বর্তমান সঙ্কটের পিছনে ভূ-রাজনৈতিক ও অর্থনৈতিক কারনগুলো একটু আলোচনা করা যাক। নিজেকে চিন মার্কসবাদী বললেও কার্যত অ্যডাম স্মিথের, 'Trade is the engine of growth' কেই মনে প্রানে অনুসরণ করে। বিশ্ববানিজ্যে, বিশেষ করে small manufacturing এর অভাবনীয় সাফল্যের পর সওদাগরবাদের নিয়ম মেনে চিন এখন বাজার সম্প্রসারনে মনোযোগী। সেই সঙ্গে ভোগ্যপণ্যের চাহিদার স্থিতিস্থাপকতা হ্রাসের সাথে সাথে নানা দেশে পরিকাঠামো নির্মানে মনোযোগী। এই লক্ষ্যে ইউরোপের নৈকট্য বাড়াতে ও একই সঙ্গে দক্ষিন চিন সাগরে সম্প্রসারিত নিয়ন্ত্রন প্রতিষ্ঠায় গড়ে তুলেছে Belt Road Initiative (BRI)।একদিকে প্রাচীন রেশম সড়ক পথে পোল্যান্ড, তুরস্ক পর্যন্ত পথ নির্মান বা China Pakistan Economic Corridor (CPER) বানানো, অন্য দিকে সিঙ্গাপুর এমন কি ভারত মহাসাগর ও আফ্রিকা পর্যন্ত সড়ক, রেল, বন্দর টেলিকম প্রভৃতি নির্মানের মাধ্যমে আন্তর্মহাদেশিও যোগাযোগ ও উন্নয়নে প্রধান উদ্যোগীর ভূমিকা নেওয়ায় এখন চিন প্রস্তুত। দ্বিতীয় বিশ্বযুদ্ধোত্তর কালে আমেরিকা এই ভূমিকা নিয়েছিল।

এই লক্ষ্যে চিন ১৩৮ টি দেশকে সামিল করেছে। গড়ে তুলেছে বিশ্ব ব্যাঙ্ক, এডিবি র মত Asia Infrastructure Investment Bank(AIIB), যার মোট অনুমোদিত মূলধনের ২৬ শতাংশ ই চিনের। সাংহাই এ অবস্থিত এই ব্যাঙ্ক এর প্রথম প্রধান ভারতীয়।

চিনের এই BRI উদ্যোগে যেমন আফ্রিকার কিছু দেশ,বাংলাদেশ, পাকিস্তান, গ্রিস, ক্রোয়েশিয়ার মত দেশগুলো প্রবল ভাবে সমর্থন করেছে অন্যদিকে ফিলিপিন্স, ভিয়েতনাম, জাপান, আমেরিকা, ইউরোপিয় ইউনিয়ন মেনে নিতে পারছে না। ভারতও সতর্কতা অবলম্বন করছে। ইউরোপের অনেক দেশ চিনের এই প্রয়াসকে নয়া উপনিবেশবাদ আখ্যা দিচ্ছে।

উনিশ শতকে ওপিয়াম ওয়ারে ব্রিটেন এবং গত শতকে জাপান চিনের ওপর যে নির্যাতন চালিয়েছিল, আজকের চিন যেন তার হিসেব চাইছে।

লক্ষ্য করলে দেখা যাবে যে ভারত-চিন সীমান্ত সংঘর্ষের সঙ্গে চিনের ভূ রাজনৈতিক ও আর্থিক স্বার্থ কেমন জড়িত। ডোকলাম সঙ্কটের মাস খানেক আগে ৩০ দেশের নেতাকে ডেকে BRI এর প্রথম সামিটে চিন প্রথম চৈনিক বিশ্ব ব্যবস্থার ঘোষনার আয়োজন করে। কিন্তু ঠিক এক দিন আগে ভারত আকসাই চিন অধিকৃত কাশ্মীরের মধ্য দিয়ে বানানো CPEC র দরুন সার্বভৌমত্ব হারানোর প্রশ্নে সম্মেলনে যোগদান থেকে বিরত থাকে। ফলে সম্মেলন বাতিল হয়।

এক ই ভাবে বর্তমান গালওয়ান উপত্যকা সংঘর্ষের কিছুদিন আগে ভারত আমেরিকা ও জাপানের সাথে কৌশলগত সম্পর্ক সুদৃঢ় করার কথা ঘোষনা করে। সেই সঙ্গে করোনা জনিত কারনে চিনমুখি বিনিয়োগ পূঁজিকে ভারতে টানার কথা বলার পরে চিন সীমান্তের তার সৈন্য সমাবেশ বাড়ায়।

স্বদেশী আমলে বিলেতী পণ্য বর্জনের মতো চিনা দ্রব্য বয়কট করা এক স্থূল উদ্ভট যুক্তি। 'স্বনির্ভর ভারতের' মধ্যেও এক ধরনের স্ববিরোধিতা লক্ষ্য করা যায়। কারণ কিছু দিন আগেই প্রধান মন্ত্রী জোরের সঙ্গে বিশ্ব সাথে যোগের কথা বলেছিলেন।

বর্তমানে চির শান্ত নেপালও ভারতের কাছে বিলক্ষন শির:পীড়া। এটা ঠিক, নেপালের বর্তমান অবস্থান ভারতের সামনে কানামাছি র মত হলেও চিনের কাছে ভারত তেমন নয়। হিন্দু দেশের তকমা ঝেড়ে ফেলে কমিউনিস্ট পার্টি শাসিত নেপালের নৈকট্য চিনের কাছে বাড়তেও পারে।

ভারতে গণতন্ত্রের দরুন কিছু অবাঞ্ছিত অস্বস্তি ও আমাদের শাসক দলের চিন্তা বাড়িয়েছে। ২০০৮ এ ভারতের প্রধান মন্ত্রীকে বেজিঙ অলিম্পিকে চিন নিমন্ত্রন না করলেও পুরো গান্ধী পরিবারকে চিনা কমিউনিস্ট পার্টি নিমন্ত্রণ করেছিল এবং সোনিয়া গান্ধীর দলের সাথে চিনা কমিউনিস্ট পার্টির একটি মৌ স্বাক্ষরিত হয়েছিল। বানিজ্যিক মৌ স্বাক্ষরিত হয় জানি।এমন দ্বিপাক্ষিক দলীয় মৌ এর বিষয় আমাদের অজানা। এর পরিপ্রেক্ষিতে রাহুল গান্ধীর গালওয়ান সংঘর্ষ জনিত প্রশ্ন বলা যেতেই পারে জিন পিংকে সাহায্য করবে। সেদেশের হিজ মাস্টার্স ভয়েজ সংবাদপত্রে সেটা প্রমানিত হয়েছে।

চিনের বুদ্ধিমুক্তিতে ভারতের অবদান সুবিদিত। আবার চিনও ভারতকে ইতিহাস সচেতন করেছে। দ্বারকানাথ কোটনিস চিনা সৈন্যদের সেবায় সেদেশে মৃত্যু বরন করেছেন। চিনের প্রবাদ প্রতিম মনীষী দার্শনিক হু শিং, যিনি মে ফোর্থ আন্দোলনের পুরোধা এবং পরবর্তী কালে পিকিং বিশ্ববিদ্যালয়ের প্রেসিডেন্ট হয়েছিলেন, তিনি একটা সুন্দর কথা বলেছিলেন,'সীমান্তের ওপাড়ে একজন সৈন্য ও না পাঠিয়ে ভারত চিনকে কুড়িটা শতাব্দী ধরে শাসন করেছে'।

আজ আমাদের কুড়ি জন জওয়ান প্রান হারাচ্ছে। চিন ভারত এই বৈরীতা বন্ধ করতেই হবে। কূটনীতিতে 'সফট পাওয়ার' কথাটা খুব প্রচলিত। আত্মবিস্মৃত ভারত বৌদ্ধ দর্শনের এই 'সফট পাওয়ার' দাবি করে না। সামরিক শক্তি অপেক্ষা কূটনৈতিক শক্তিকে কাজে লাগাতে হবে। প্রধান মন্ত্রী নাকি আট বার চিনে গেছেন।
প্রধান মন্ত্রী হয়ে প্রথম আমন্ত্রণ করেছেন জিন পিংকে। সাবরমতি তীরে দোলনায় দুলেছেন। চৈনিক প্রযুক্তিতে বিশ্বে বৃহৎ সর্দার প্যাটেলের মূর্তি বানিয়েছেন। তাঁর পরেই গালওয়ান। এ যেন চৌ-নেহেরু নৈকট্যের পর নাথুল এপিশোডের পুনরাবৃত্তি। চিনের বিশ্বশক্তি হওয়ার পথে বড় অন্তরায় গণতন্ত্রের অনুপস্থিতি। কাল্পনিক ড্রাগনের গতির কাছে ভারতীয় কুঞ্জর মন্থর হলেও শক্তিশালী।

নেপোলিয়ন নাকি বলেছিলেন চিন এক ঘুমন্ত দানবী।‌ ক্যান্টন দেখে বিবেকানন্দও চিনের ভবিষ্যত সাফল্যর পূর্বাভাস দিয়েছিলেন। ভারত এবং চিন এই দুই দেশের কেউই কাউকে ছেড়ে ভবিষ্যতে থাকতে পারবে না। এটা দুদেশকেই মানতে হবে।

আমরা, যারা সতেরো দিনে কনডাকটেড ট্যুরে চিন ভ্রমনে যাই, তারা ঝাঁকে ঝাঁকে পঞ্চাশ তলা বাড়ি, চোখ ধাঁধানো সাংহাই স্কাই লাইন, বারো লেন রাজপথের একটা মিনি আমেরিকা দর্শন করে আসি। এমন কি পশ্চিমী বৈভবের মাঝে লাসাকেও খুঁজতে হয়। একথা ঠিক, কন্ডাকটেড ট্যুরে নিউ দিল্লী, নয়ডা, মুম্বাই, নিউটাউন দেখলেও এক ই অনুভূতি হতে পারে। কিন্তু টিবেটান রেলওয়ে, বহুতল বেজিং রেল স্টেশনে শয়ে শয়ে বুলেট ট্রেনের আনাগোনা কিংবা সাংহাই শহরের চারশো কিমি গতির ম্যাগগ্লেভ ট্রেনের ছুটোছুটিকেই বা অস্বীকার করি কী করে? এগুলোর প্রায় সবটাই বাস্তব করেছে মাওয়ের নয়, দেং পিয়াও শিং এর চিন। মাও এর চিন রেলপথ উন্নয়নে আমাদের চেয়ে যোজন মাইল পিছনে ছিল তখন ষাটের দশকে তিন কোটি লোক সে দেশে দুর্ভিক্ষে মরেছিল। চিনের এই ড্র্যাগনিয়ান উত্তোরণ ১৯৭৮ এ অর্থনীতিকে উন্মুক্ত করে মুক্ত কচ্ছ পুঁজিবাদী বিকাশের মাত্র তিন দশকের গল্প, যখন অন্যতম লক্ষ্য ছিল বার্ড নেস্ট স্টেডিয়ামে বেজিং অলিম্পিকের উদ্বোধন। সেই সময়, ১৯৭৮ এ আমাদের ভারতবর্ষ ঘড়ির কাঁটাকে উল্টো পথে ঘোরাতে চেয়ে বেশি মাত্রায় অন্তর্মুখী হয়েছিল। নরসিংহ-মনমোহন জমানায় বামপন্থীদের প্রবল বিরোধিতা সত্ত্বেও গ্যাট চুক্তির শরিক হওয়াটা তখন কেবল choice ছিলনা, হয়ে উঠেছিল compulsion. তের বছর ভারতের এই শশক নিদ্রাকালে কেবল চিন ই নয়, অন্য অনেক দেশ ও আমাদের ফেলে অনেক দূর চলে গেছে। ১৯৪৮ এ এক ইউ এস ডলার ছিল আমাদের এক টাকার সমান। আজ চিনের এক ইউয়ান আমাদের দশ টাকা। সুতরাং একথা আমাদের মানতেই হবে, 'সত্যরে লও সহজে'।