বাঙালি জীবনে সুফি (দ্বিতীয় পর্ব) - গৌতম রায়

কর্মবিমুখতাকে সুফিরা কখনোই এতোটুকু প্রশ্রয় দেন নি। প্রকৃত কাজ কে ত্বরান্বিত করতে কাজের ইচ্ছার যে একটা অত্যন্ত গভীর মূল্য আছে- সুফিদের এই মানসিক গঠনের সঙ্গে প্রাচীন পন্থী ইসলামীয় আইনবিদদের প্রথম থেকেই একটা সংঘাত শুরু হয়ে যায়।জীবনধারণের পদ্ধতির সঙ্গে শরিয়ত নির্ধারিত নিয়মকানুনের বাধ্যবাধকতা ঘিরে সুফিরা কেবল যে সংশয়ী ই ছিলেন, তা নয়।শরিয়ত নির্ধারিত যাপনচিত্রের একটা ঘেরাটোপ কখনোই অন্তর থেকে মেনে নিতে পারেন নি। তাই বাধ্যতামূলক অনুষ্ঠানের অবশ্য কর্তব্য ঘিরে শরিয়তি বিধি বিধান সুফিদের পক্ষে মেনে নেওয়া সম্ভব ছিল না।তাই ধীরে ধীরে উভয়ের ভিতরে সম্পর্কটা শীতলতার পর্যায় অতিক্রম করে ক্রমে একটা সংঘর্ষে স্থানান্তরিত হল। ইসলামীয় সমাজের রক্ষণশীলেরা সুফিদের ঘিরে বীতরাগ হয়ে উঠতে শুরু করলেন। ক্রমশঃ তাঁরা সুফিদের একটা বড়ো রকমের সন্দেহের চোখে দেখতে শুরু করলেন। সেই সন্দেহের পরিবেশ অচিরেই সংঘর্ষের রূপ নিল। বিরোধ ক্রমশঃ তীব্র হয়ে উঠতে শুরু করল। মুসলমান শাসকদের উপর এইসব প্রাচীনপন্থী শাস্ত্রবিদদের খুব বেশি রকমের প্রভাব ছিল।ফলে শাসকেরা রক্ষণশীল আইনবিদদের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে নানা ভাবে সুফিদের উপর বিরক্ত হয়ে উঠতে শুরু করলেন। সেই বিরক্তি থেকে শুরু হল বিবাদ- বিসংবাদ। বাঙালি জীবন একদিকে যেমন সুফিদের মরমীয়া ধারার দ্বারা প্রভাবিত হয়ে প্রেমের প্লাবনে ভাসতে শুরু করল, তেমনি ই অপরদিকে মুসলমান শাসকেরা প্রাচীনপন্থী আলেমদের প্রভাবে পবিত্র ইসলামের শুদ্ধতা রক্ষার তাগিদে এইসব সুফিদের উপরে নানা ধরণের অত্যাচার চালাতে শুরু করলেন। সেইসব অত্যাচার বাংলায় মরমীয়া সাধনার বিকাশের ধারা কে একদিকে যেমন ক্ষতিগ্রস্থ করেছে, তেমনি অপর দিকে সাম্প্রদায়িকতার মূল উৎপাটনে সুফিদের যে ঐতিহাসিক অবদান এবং প্রভাব হিন্দু - মুসলমান নির্বিশেষে মানুষের মনের কালিমা দূর করবার কাজ করতে শুরু করেছিল, সেই কাজটিও ক্ষতিগ্রস্থ হয়েছে।রক্ষণশীল সমাজের সঙ্গে সুফিদের যে আদর্শগত দ্বন্দ্ব, অনেক সময়েই যা সংঘাতের আকার ধারণ করেছিল, তার রেশ শাসকদের কে পর্যন্ত প্রভাবিত করেছিল। শাসকেরা প্রভাবশীল সমাজের দ্বারা প্রভাবিত হয়ে বহু ক্ষেত্রেই সুফিদের উপর ভয়ঙ্কর আক্রমণাত্মক ভূমিকা ও নিয়েছেন। গোটা ভারতীয় উপমহাদেশ জুড়ে এমন ঘটনার বিশ কিছু দুঃখজনক উদাহরণ আছে।
একটা দীর্ঘ সাধনপথের ভিতর দিয়ে সুফিরা তাঁদের জীবনকে, ভাবনাকে অতিবাহিত করেন। সুফি তরিকাতে বেশ কয়েকটি স্তর আছে। সুফি সন্তদের প্রচলিত লব্জে এই স্তরগুলিকে বলা হয় ' মকাম' । সুফি সাধকদের বিশ্বাস, তাঁদের সাধনার বিভিন্ন স্তরগুলি অতিক্রমের ভিতর দিয়েই তাঁরা বিশেষ অবস্থার ভিতরে আসেন। সমস্ত স্তরগুলি যে সাধকদের পক্ষে অতিক্রম করা সম্ভবপর হয়, তাঁরা একটা সর্বোচ্চ স্তরে নিজেদের উপনীত করতে পারেন।' মারিফত' এই শব্দটির বাংলা করলে দাঁড়ায়, প্রকৃত জ্ঞানের ভিতর দিয়ে আসল সত্যের সঙ্গে সম্পৃক্ত হওয়া। সুফি সাধনায় এবং সুফি সন্তদের তাত্ত্বিক অভিধারাতে এই ' মারিফতে' র বিশেষ গুরুত্ব রয়েছে। তবে' মারিফত ' ই কিন্তু সুফি সাধনার শেষ কথা নয়। তাঁরা এই স্তরে উন্নীত হওয়ার পরেও ' বকায়' নামক একটি বিশেষ স্তরের জন্যে সাধনায় নিজেদের নিয়োজিত রাখেন। এই ' বকায়' স্তরের সবথেকে গুরুত্বপূর্ণ পর্যায় হল; রিপু দমন। মহা সত্যে নিজেদের বিলীন করার ক্ষেত্রে রিপু দমনকে সবথেকে বেশি গুরুত্ব দিয়ে থাকেন সুফি সন্তেরা।
সুফি সাধনাতে একটা গুপ্ত ধারা আছে।তবে সেই গুপ্ত ধারাতে বাউল - ফকিরদের মত দেহতত্ত্ব ভিত্তিক পর্যায় সে ভাবে নেই। রিপু দমন কে বেশরা সাধকেরা যে অভ্যাসের ভিতর দিয়ে আনেন, সেই অভ্যাসের প্রচলিত পর্যায় কখনোই সুফি সাধকদের অভ্যাসের দৈনন্দিনতার ভিতরে দেখা যায় না।কিন্তু সংসারী মানুষদের প্রচলিত দৃষ্টিভঙ্গির সাথে এঁদের ভাবধারার একটা বিশেষ রকমের পার্থক্য আছে। যে কোনো মানুষ, দুদিন কোনো সুফি সন্তের সাধনা করলেই, তাঁদের তরিকার গুহ্য কথা কিন্তু জানতে পারেন না। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের যেমন বইপত্র থাকে, সুফি সাধকেরা তেমন কিছু নিজেরা কখনো রচনা করেন নি।তাঁদের রচিত শায়েরি, সঙ্গীত এবং অনুরাগীদের কাছে বলা নানা উপদেশের ভিতর থেকেই তাঁদের উদার, মানবিক, পরের প্রতি ভালোবাসাতে ভরপুর দৃষ্টিভঙ্গির পরিচয় আমাদের সামনে উঠে আসে।প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে যে জাগতিক কামনা - বাসনা গুলির কথা কখনো প্রকাশ্যে , কখনো গুহ্য ভাবে থাকে, তেমন পার্থিব জগত সম্পর্কে এতোটুকু আকর্ষণমূলক কোনো শব্দ ই সুফি সন্তদের দ্বারা তাঁদের কাওয়ালী, শায়েরি বা সাধারণ কথোপকথনের ভিতরে একটি বারের জন্যে ও উঠে আসে না।
সুফি তরিকাতে যে ' মকামে' র বিভিন্ন পর্যায় গুলির কথা বলা হল; সেই পর্যায় গুলি খুব উদার মানসিকতা নিয়ে যদি বিশ্লেষণ করা যায়, তাহলে দেখতে পাওয়া যাবে যে,ওই স্তরগুলির ভিতরে প্রেমের, ভালোবাসার, সম্প্রীতির জয়গানের অনুরণনে বহু ক্ষেত্রেই দর্শনের ভাববাদী চিন্তাধারা কে অতিক্রম করে , অনেক বেশি প্রত্যক্ষ হয়ে উঠছে বস্তুবাদী ভাবনা এবং দৃষ্টিভঙ্গি। ভালোবাসাতে আত্মিক সমর্পণের একটা অনবদ্য কাকুতির নাম সুফি দর্শন।
' তওবা' ঘিরে প্রাতিষ্ঠানিক রীতি নীতির সঙ্গে সুফি তরিকার রীতি নীতি মেলে না।তওবার ভিতর দিয়ে সুফি ভাবধারাতে বিশ্বাসীরা সংসার ত্যাগ করেন । তাঁদের এই সংসার ত্যাগের পিছনে একমাত্র উদ্দেশ্য থাকে মহান আল্লাহের ইবাদতে নিজেকে সম্পূর্ণ সমর্পণের জন্যে প্রতিজ্ঞাবদ্ধ হওয়ার বিষয়টি। সৃষ্টিকর্তার প্রতি সর্বাত্মক আত্ম অর্পণ সুফি সন্তদের কাছে তওবার একটি বাঙ্ময় রূপ হিশেবে পরিস্ফুট হয়।
' জেহাদ' শব্দটির অর্থ এবং প্রয়োগ প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের মানুষজনেরা যে ভাবে করেন, তার সঙ্গে সুফিদের কাছে এই ' জেহাদে' র যে দ্যোতনা, তার এতোটুকু সাদৃশ্য নেই। সুফিদের কাছে জেহাদ কখনো ই সংঘাতের পরিমন্ডলের বার্তাবাহী কোনো ভাবনা নয়। বস্তুত সুফি তরিকার সঙ্গে ' সংঘাত' নামক শব্দটি বা এই শব্দের প্রত্যক্ষ- পরোক্ষ প্রয়োগ জনিত অভিব্যক্তির এতোটুকু সম্পর্ক নেই।প্রেমের ভাষাই হল সুফিদের ভাষা। তাঁদের সাধনার কোনো স্তরে সংঘাতের এতটুকু ঠাঁই নেই।জেহাদকে সুফি সন্তেরা নিজের আত্মার যাবতীয় নেতিবাচক পর্যায়ের বিরুদ্ধে লড়াইয়ের একটি অস্ত্র হিসেবে ব্যবহার করে থাকেন।যাবতীয় কামনা বাসনার শরীরবৃত্তীয় তাগিদকে অতিক্রম করতে আত্মার সঙ্গে লড়াইয়ের প্রশ্নেই সুফি জীবনে আসে ' জেহাদ ' নামক শব্দটি।আসে ' জেহাদ' শব্দের অর্থবোধক উপজীব্য বিষয়ক্রমগুলি। কখনো বাইরের কোনো শত্রুর বিরুদ্ধে নিজেকে বা নিজের ভাবাদর্শের মানুষকে উত্তেজিত করতে এই ' জেহাদ' শব্দ বা শব্দটির কোনো আক্ষরিক অর্থ কিংবা তার প্রয়োগজনিত কোনো তাগিদ কখনোই সুফি সন্তরা ব্যবহার করেন না। ( চলবে)।