
আমরা যখন কোনো কবিতা বিচ্ছিন্নভাবে পাঠ করি তখন হয়ত তাকে কিছুটা অসংলগ্ন মনে হয়। কবিতার গভীরে প্রবেশ করার ইচ্ছেটাও সেক্ষেত্রে উবে যেতে থাকে। তাই মনে হয় কবিতা জানার আগে কবিকেও একটু জেনে নিয়ে কবিতা পড়লে কবিতাকে বুঝে নিতে, তাঁর পাঠ প্রকল্পকে জেনে নিতে সুবিধে হয়। একটি শব্দের চকিত উদ্ভাস হয়ত পুরো কবিতার দ্যুতিকে বদলে দিতে পারে। তাই কবি গীতা চট্টোপাধ্যায়ের কবি জীবন নিয়ে আলোচনার পূর্বে তাঁর পারিবারিক ও তাঁর পড়াশুনোর বৃত্তান্তটা একটু জেনে নিতে চেষ্টা করব। কবির জন্ম ১৯৪১ সালে ২১শে শ্রাবণ। ১৯৪১ এই সাল টি বাঙালির মনন চর্চায় বিষাদের অক্ষরে লেখা হয়ে রয়েছে। আমরা শুধু যে সে বছর সবটা হারালাম তা হয়ত নয়। আবার একটু পেলামও। একজন চলেও এলেন। তিনি গীতা চট্টোপাধ্যায়। পিতা ছিলেন সংস্কৃত শাস্ত্রচর্চার একজন যশস্বী মানুষ। আবার মাতামহ শম্ভুনাথ বন্দ্যোপাধ্যায় শ্রীপাদ ভক্তিবিনোদ গোস্বামীর প্রত্যক্ষ শিষ্য। ফলে তাঁর রক্তে স্বাভাবিকভাবেই এসে পড়েছে সংস্কৃত সাহিত্য প্রীতি ও ভক্তি ভাবাবেগের কাঙ্ক্ষা। তাঁর শিক্ষার পঠিত বিষয় ছিল বাংলা। একটু যোগ করাই যায় তিনি এম.এ তে প্রথম শ্রেণিতে প্রথম হয়েছিলেন এবং পরবর্তীতে ভাগবত গবেষণায় পি.এইচ.ডি ডিগ্রী লাভ করেন। তাঁর এই মেধাবী চলাচলের সাথে মিলে যায় গায়ত্রী চক্রবর্তী স্পিভাক। আবার অমিলও লক্ষ করি। গায়ত্রী যেখানে সারা পৃথিবী ঘুরে বেড়িয়েছেন, সেখানে গীতা ছিলেন অন্তঃপুরবাসিনী। তাঁকে আমরা যৌবনে মজা করে বলতাম বাংলা কবিতার সুচিত্রা সেন। এরকম বিদূষী বাংলা কবিতায় বেশি নেই। জগদীশ ভট্টাচার্যের মতো মানুষের কাছে তাঁর কাব্যাদর্শের পাঠগ্রহণ। ফলে তাঁর কবিতার ভেতর ছড়িয়ে থাকবে অনেক অজানা খিলান, নির্মিতির নানান মৌন অবলম্বন এটাই স্বাভাবিক। তিনি কিছু কবিতায় আবার এতটাই সহজ হয়ে গিয়েছেন যা পড়ে সত্যিই বিশ্বাস করা কঠিন এতটা সহজ তিনি কীভাবে হলেন। এও বোধহয় পাণ্ডিত্যের অন্য মুদ্রা। এই সহজ ভাষায় লেখা একটি বরং আপনাদের শুনিয়ে নিই। পরে অন্য আলোচনায় যাব।
" গভীর নাড়ির সঙ্গে লবণাক্ত জল যোগ করে
সেবিকা উদ্বিগ্ন মুখ, আজ রাত কাটে কি কাটে না
আপনাদের মধ্যে কেউ যে হোক একজন থেকে যান কে থাকবে, সকালেই শ্রম অসন্তোষ মোকাবিলা
কে থাকবে, বেবির স্কুল হোমটাস্ক, হুইমসিকাল ম্যাম
কে থাকবে, সাইনাসে একটু মাথা ধরেছে যেন
কে থাকবে, কুকটা গত কয়েকদিন ধরেই আসছেনা
যাদের সবার জন্য কতরাত জেগে কেটে গেছে
তার জন্য শেষবার আজ রাতে কেউ থাকবেনা। "
আপনারাতো পড়লেন কবিতাটি। কেমন একটা শিহরণ পেলেন! একজন নারী যিনি মা তিনি চলে যাচ্ছেন এ পৃথিবী ছেড়ে, তিনি আর তার প্রিয় বাড়িতে ফিরবেন না। যিনি সেবিকা যার হয়ত তিনি কেউ নন, সেই সেবিকার মুখও বেদনায় করুণ হয়ে আছে। অথচ যাদের তিনি বুক দিয়ে আগলে রেখেছেন, ওম্ দিয়ে বড়ো করে তুলেছেন তাদের প্রত্যেকেরই কোনো না কোনো কাজ এসে জুটেছে। তারা কেউই তাদের কাজকে সরিয়ে ফেলতে পারছে না নয়, চাইছে না। এমনই সংকট কালে এসে আমরা উপস্থিত হয়েছি। মৃত্যুর মতো গাঢ় বিষাদও আজ আমাদের মনে সেভাবে রেখাপাত করেনা। এমনই সভ্যতার কাছে এসে আমরা পৌছে গেছি। এই পৃথিবীতে আর কিছুক্ষণই তিনি হয়ত আছেন। তবুও আমরা তার জন্য একটুও সময় নষ্ট করতে রাজি নই। কবিতাটি পড়ছি আর গা ঠান্ডা হয়ে আসছে।
' গৌরীচাঁপা নদী, চন্দরা ' তাঁর প্রথম কবিতার বই। ' ' কবি ও কবিতা ' প্রকাশনী থেকে ১৯৭৩ সালে প্রকাশিত। পরবর্তীতে প্রকাশিত হয় ' জলেহস্মিন সন্নিধিংকুরু ' ও ' বঙ্কিমচন্দ্রের হাতে বঙ্গ ইতিহাস '।প্রকাশিত হয়েছে একটি গবেষণা গ্রন্থ ' ভাগবত ও বাংলা সাহিত্য ' যা তাঁর পি.এইচ.ডি-র থিসিস। ' মীণাঙ্ক সোপান ' নামে একটি কাব্যনাট্য।
তাঁর রচনার সংখ্যাগত পরিধি খুব বেশি নয়। তবুও তার প্রতি বাংলা সাহিত্যের ঋণ থেকে গেছে। সংখ্যার পরিমাপ দিয়ে তো আর সাহিত্যের গুনপনা বিচার করা যায় না। তবু একটা সংখ্যাও প্রয়োজন হয় বই কী। তবে তিনি যে কবিতা চর্চা করেছেন বা তিনি গদ্যে যে বিশেষ ভঙ্গিমা দেখিয়েছেন তাতে তাঁর পারদর্শিতা নিয়ে সংশয় মাত্র নেই। তিনি বাংলা কবিতায় ফিরিয়ে এনেছেন অষ্টাদশ, উনিশ শতকের আবহ। এই উনিশ শতককে আমরা এত কাল যেভাবে জেনে বুঝে এসেছিলাম, অষ্টাদশ শতককে যেভাবে জেনেছিলাম তা বোধহয় কিছুটা উপরিতলের ইতিহাস। এবার তাঁর কবিতায় পেলাম গর্ভের খোঁজ। ইতিহাসের গর্ভ, যেখানে লুকিয়েছিল অনেক মণি-মানিক্য। অদ্ভুত এই, যা তিনি প্রবন্ধের তাত্ত্বিকতায় নিয়ে আসতে পারতেন তাকে তিনি তুলে আনলেন কবিতার নিপুণ লাবণ্যে। এটাই হয়তো বাংলা কবিতায় গীতা চট্টোপাধ্যায়ের একটা বড়ো দান বলে অনুমান করতে পারি। হয়তো এই অনুসন্ধানের কাজ তিনি করতে চেয়েই নিভৃত বাসের জীবন বেছে নিয়েছিলেন পাছে এই সভ্যতার উষ্ণ আবহাওয়া তাকে সামান্য বিরক্ত না করে। তিনি এতটাই কবিতাকে ভালোবেসে ছিলেন যে তার জন্য তিনি নিজের জীবন পর্যন্ত সমর্পণ করতে দ্বিধা করেননি। কেউ তাঁর সাক্ষাৎকার নিতে চাইলে তিনি মনে মনে তাই খুব বিপদে পড়তেন। এটা হয়তো কারো কারো কাছে খুবই বিষাদের কারণ হয়ে উঠেছে। কিন্তু যিনি প্রাচীন ইতিহাসের নব নব অঙ্কুর সমাকীর্ণ হয়ে আছেন, তাঁর তো এরকম একটু হবেই। একটা আত্ম আবরণ তাঁর দরকার পড়বেই। যদি তিনি সত্যই কঠোর মানুষ হতেন তবে তিনি কিশোরীদের উদ্দেশে কীভাবে লিখবেন -- ' ফিরে গিয়ে তাপ নাও মায়ের বুকের উষ্ণতার। '
হ্যাঁ যে কথা বলছিলাম তাঁর কবিতা জুড়ে ইতিহাসের খোঁজ।
" প্রথাবন্দী অন্ধকার, কুচিৎ ঝরোকা
কাঁচে পিতামহ মাতার ঘুলঘুলি
ঘড়ঘড়ির পাখি বন্ধ গানের গলার রেশ
চাপড়া চাপড়ি চোরা গলি বেয়ে
রবীন্দ্রনাথের প্রেম নির্বাসিত অঙ্গরের
পাতাল-গোধূলি। সিঁড়ির তলায়
তীব্র খোঁজ প্রহরীর চোখ শাসনের ইস্পাত ফলকে "
আবার কোথাও থেকে যাচ্ছে পুরাণের স্পর্শ --
" কবে যেন একদিন ঐ বুকে তৃষ্ণা তার ছেড়ে এসেছিলি
ফিরে পেতে চায় না সে ভূমন্ডল মধ্যবর্তী জুড়ানো সন্তাপ
তাকে তুমি হাতে তুলে কেননা দিয়েছ বিষ স্তম্ভিত আগুন :
' ভ্রষ্ট হয়েছিস তুই ' পাননি পরশুরামও মাতৃ অভিশাপ "
( জননী )
আমরা দেখি -- পানসাজি,যশোহরের চিরুনি, খোঁপা বাধার অনুভূতি, রসকরা খিচুড়ির হাঁড়ি, খোকার কাজল মুঠি, চোঙওলা বৃদ্ধ গ্রামাফোন, পুরোনো কলকাতার আলো, রোহিনী ও বারুনির ঘাট। এসমস্তই কবিতার সহজতম সত্য হয়ে ওঠে।
কাঁন বিঁধিয়ে প্রথম পরা নিমকাঠিটি দিয়ে যাবো
সোনার ছোটো মাকড়ি দুটি দিন ও রাত্রি দিয়ে যাবো
দিদি কাঠের খেলনা দিলো, গোলাপ পিসি কাশীর প্যাঁড়া
গোপাল দোলে যে মঠ খাবে ফুটকড়াই আর লুট বাতাসা
বিষ্ণু পটচিত্র ঘিরে সারা সকাল ঘিরে চন্দনে ওঁ
এভাবেই তাঁকে আমরা ধরতে পারবো এবারে যদি তাঁর লেখা গদ্য পরিক্রমায় যাই। সেখান থেকেও বুঝে নিতে পারব তাঁর অনুভবের চিত্রপট। সেখানে আছেন -- বীরেন্দ্র চট্টোপাধ্যায়, মণীন্দ্র গুপ্ত, আলোক সরকার, শক্তি চট্টোপাধ্যায়, অলোক রঞ্জন দাশগুপ্ত, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, শঙ্খ ঘোষ। আছেন অমিতাভ গুপ্ত, জয় গোস্বামী, কবিতা সিংহ, দেবঞ্জলি মুখোপাধ্যায়, দেবীপ্রসাদ বন্দ্যোপাধ্যায়, বিশ্বদেব মুখোপাধ্যায়, দেবদাস আচার্য, সুধীর দত্তের মত কবিদের। বহুবিধ এই আলোচনায় তিনি যে বাক্যবন্ধ ব্যবহার করেছেন তাঁকে আমরা পেতে পারি। সেখানেও রয়েছেন তিনি এক সম্পন্নবোধের কবি হিসাবে।
তিনি লিখলেন --' শঙ্খ সরে দাঁড়ালেন যে কোনো সংঘ থেকে দূরে ' অর্থাৎ এই লাইনটি দীপ্তভাবে না হলেও মন্দ্র সুরে ঘোষণা করে যে তাঁরও পক্ষপাত এই ' দূরে ' শব্দটির প্রতি। অলোকরঞ্জনের কবিতা প্রসঙ্গে তিনি জানালেন -- ' আত্মপরীক্ষার পরে আত্মআবিষ্কারের গুরুত্ব কম নয়। '
আমরা গীতা দেবীর রচনাতেও এই অভিনিবেশ লক্ষ করি। তিনি অন্যমনস্কভাবে লিখলেন ' উদাসীন চলে যাওয়ার আকাঙ্ক্ষা শক্তির সমস্ত সত্তায় মিশে রয়েছে। ' এমন একটি মন কি আমরাও তাঁর ভিতর খুঁজে পেলাম না ? এলিয়টের প্রসঙ্গ তুলে কবি আমাদের জানালেন -- এলিয়ট কবিদের দু-জাতে বসিয়েছেন -- মৌলিক আর ব্যুৎপন্ন। আমরা মনে করি এই উভয় সত্তার অধিকারী এই কবি। তিনি নানাভাবে নিজেকে ভাঙতে চেষ্টা করেছেন। এক শৌর্যময় দীপ্তি এনেছেন বাংলা কবিতায়। আকাশ যেমন অতীত
,বর্তমান,ভবিষ্যৎ কে ধারন করে থাকে তেমনি তিনি সেই আকাশ। মহাপুণ্যবলে বাংলা কবিতা তাঁকে পেয়েছে।