শূন্য হাতে ফিরে হে - রজত চক্রবর্তী

ভালো আছি, বলার সাথে সাথে এই বার্তা দেওয়া হয় যে, তোমার কোমর ভাঙেনি, তোমার পটি, হিসু ও ঘুমের কোন সমস্যা হয়নি, তোমার পরিবারের কেউ সম্প্রতি অসুস্থ বা মারা যায়নি ইত্যাদি ইত্যাদি অস্বাভাবিক কিছু হয়নি। এই না হওয়াটাকেই অ্যাড্রেস করা হয়, ভালো আছি বলে। বরফে ডুবে থাকা মাছ যেমন ভালো থাকে নির্লিপ্তির শীতলতায়, তেমনই ভালো থাকতে চেয়েছিল সুরমা। একটু হাসি, অল্প কাশি, খুসখুসে খুনসুটি, এইসব নিয়ে হ্যা হ্যা হ্যা ভালো থাকার স্টিকার মুখে লটকে ঘুরে বেরাবার এই মহা জীবন। সুরমা এমনিই চেয়েছিল, যেমন চাওয়া দেখে এসেছে এযাবৎ। যেমন, যে চাওয়াটা অভ্যাস হয়ে গেছে বা অভ্যাস করে দিয়েছে চারপাশ বা অভ্যাসে পরিণত হয়েছে, তার বাইরে তাকানোর ফুরসত ছিল না খুব একটা বেড়ে ওঠার পাটিগণিতে। বৃষ্টি এলো খুব। যেমন আসে। জল গড়িয়ে গড়িয়ে ছুঁয়ে ছুঁয়ে দেয় গোপন। আহা গোপন ভিজে ভিজে ওঠে। নীরবে । খিলখিল হেসে ওঠে শরীরের ভাঁজ। ভাঁজে ভাঁজে প্রতিরোধহীন কেঁপে উঠা উল্লাসধ্বনিতে সুর বোনা হচ্ছিল । উপরে দামাল আকাশের দিকে দু'বাহু তুলে সরমা সংগীত হয়ে উঠল। ধীরে ধীরে সবুজ জলজ সরমা আমাকে বৃষ্টির ভেতর নিয়ে গেল। আমাকে নদীর ধারে নিয়ে গেল। আমাকে জঙ্গলের গভীরে নিয়ে গেল। আমাকে গাছের ভাষায় ভিজিয়ে তুলল। আমাকে পাহাড়ের পথে পথে পথের গান শোনাল। সরমা ও প্রকৃতি সমার্থ হবার পথে অযুত কোটি নিযুত বাধার পাহাড় তৈরী করে রেখেছে যুগে যুগে মানুষ সামাজিক হতে গিয়ে। যতখানি নিদানখোড় হতে হয়। কোন নারী আর আমাদের কাছে প্রকৃতি হয়ে উঠতে পারেনি আহা ! পারতে দিইনি ! নারীকে নারী করে রাখার সমস্ত উপাচার সাজিয়ে রেখে বলেছি - তুমি ,তুমি শুধু উৎপাদক যেমন মাটি, শুধু মাটি, ভূ। মুহূর্তেই সমগ্র প্রকৃতি থেকে বিচ্ছিন্ন করে শুধু মাটি দেখতে শিখলাম। হলকর্ষণে উঠেছে ফসল। চলো বন্দনাগীত রচনা করি। চলো কাব্য, চলো কবিতাবলি... সমগ্রতা থেকে অংশকে ছিন্ন করার খেলায় মেতে উঠেছি। গাছের থেকে ফুল, নদীর থেকে জল, পাহাড় থেকে পাথর...নারী থেকে তার মুখ, ঠোঁট, চুল, বুক, সব সব আলাদা আলাদা টুকরো টুকরো করে রেখেছি সাজায়ে। রচনা করেছি কথামালা। অংশ থেকে সমগ্রে ফেরার পাঠ নেওয়া হয়নি এখনও। টুকরো অংশ আরো টুকরো টুকরো হতে হতে তার রূপ পাল্টে পাল্টে যাচ্ছে । তাপ-উত্তাপহীন এক দর্শন মোহে চলেছি, যা বলতে হয় বলে জেনেছি, তাই বলে চলেছি। সরমা, সরমা তোমাকে সম্পূর্ণ তোমার মতো করে দেখা হলো না। টুকরো টুকরো ... আর্ট কলেজের ন্যুড স্টাডি। সামনে রসট্রামে নগ্ন নারী, জ্যান্ত। বুকের সুডোল দুলছে নড়াচড়ায়। পেনসিলের ঘষায় ঘষায় খাতার পাতায় তার বিভঙ্গ । খোলা বুক। উন্মত্ত উনিশ। তবুও কোন উত্তেজনা নেই। নেই বাঁধন ছেঁড়া উচ্ছাস, যা ছিল ক্লাসের আগে, যা থাকে ক্লাসের পরে। সমগ্র থেকে অংশকে আলাদা করে দেখার এই খেলা। প্রতিক্রিয়া যা থাকে সমগ্রের প্রতি তার বিলুপ্তি ঘটে সমগ্রকে টুকরো করে দেখার প্রক্রিয়ায়। জগত জুড়ে সমগ্র কে ভাঙ্গার এক উৎসবে মেতে ওঠার উৎসব উদযাপন । সমগ্র দেখতে চাওয়ার সংঘাত আবার উল্টো দিকে। সুরমার ঠোঁট খুলে খিলখিল উড়ে গেল পাখী । চোখের কপাট খুলে তিরতির উড়ে গেল মেঘ। জঙ্গলের গভীরে সেদিন হু হু নিস্তব্ধতা । গাছেরা স্থির । পাতারাও চুপ। লতা কোনো দুলে উঠছে না বৃক্ষের শাখায় । ঝিরঝিরে সবুজ বৃষ্টি নেমে এলো। জঙ্গল জুড়ে নানা শব্দের সিম্ফনি । খসে পড়া খয়েরি পাতায় জলের শব্দ, সবুজ কচি পাতায় জলের শব্দ, গাঢ় সবুজ পাতায় জলের শব্দ, শক্ত পাতায়, নরম পাতায়, কচি ডালে, কান্ডে , ঘাসে ঘাসে ভিন্ন ভিন্ন শব্দের লহড়ি তুলে বৃষ্টি অঝোর । সুরমা ক্রমশ ক্রমশ সবুজ বৃষ্টিতে ধুয়ে যাচ্ছে । ওর ফরসা হাত ক্রমশ দীর্ঘ হতে হতে আকাশ অভিমুখ । সবুজ জলজ সুরমার হাত। সুরমার শরীর ধীরে অতি ধীরে সবুজ হয়ে উঠছে। জলের হাত আমার হাত ধরলো। আমার হাত সবুজ, লতাপাতাময়, ভেজা, জল ছল ছল হয়ে উঠছি... সমগ্রতার সাথে মিশে যেতে যেতে যেতে খেয়াল করি আমার ফেরার সময় হয়েছে । অংশ নিয়ে বেঁচে থাকার জীবন আমায় ডাকছে...তোমাকে আর তুমি বলে পাবো না কখনও!!??