এই লেখা আমাদের সেই লক্ষ লক্ষ দুঃখী দুর্ভাগা ভাই-বোনের দূর-অতিদূর ঘরে-ফেরার পদযাত্রা নিয়ে নয়, যা আজকাল টিভি চ্যানেলগুলোর অন্যতম উপজীব্য। এমন কি সরকার সম্বন্ধে বা রাজনীতি কি অর্থনীতি সম্বন্ধেও কোনও রচনা এ নয়। নয় কোনও সমালোচনা বা গুরুসুলভ উপদেশবাণী। মিস্টার মোদী সম্বন্ধে, কিম্বা তাকে যারা বিশ্বাস করেছিল তাদের ওপর তিনি যে অবর্ণনীয় দুঃখকষ্ট বর্ষণ করেছেন, সে সম্বন্ধেও নয়। সে বিষয়টা তার এবং তার স্রষ্টার মধ্যেই সীমাবদ্ধ থাক। আর আমি কামনা করি যে তাকে যিনি সৃষ্টি করেছেন তিনি যেন তাকে ক্ষমা করেন, কারণ ইতিহাস কোনোদিনই তাকে ক্ষমা করবে না । এ-লেখা কোনও অপদার্থ অর্থমন্ত্রীকে নিয়েও নয়, যার মুখের প্রতিটি ভাঁজে লেখা আছে ঔদ্ধত্য । এই লেখা নয় কোনও বিচারব্যবস্থা নিয়ে--- যা তার নৈতিক দিশাকে ছুঁড়ে ফেলে দিয়েছে উচ্চাশা ও পক্ষপাতের বন্ধ্যা মরুভূমিতে । কোনও মিডিয়া সম্পর্কেও এ লেখা নয়, ফাউস্টের মতো যারা শয়তানের কাছে আত্মাকে বেচে দিয়ে, বদলে তাদের দিকে ছুঁড়ে দেওয়া তুচ্ছাতিতুচ্ছ উচ্ছিষ্টেই তুষ্ট । রাহুল গান্ধী, মায়াবতী বা নীতিশ কুমারও এ লেখার বিষয় নন, কারণ মর্মান্তিক ঘটনাবলীর ঘনঘটায় এই মুহূর্তে তারা অপ্রাসঙ্গিক।
এ-লেখা হল আমি আর আমার মনের ভার নিয়ে, যে এক চরম লজ্জাকর বোঝা আমি বহন করে চলেছি গত কয়েক সপ্তাহ ধরে, যত চেষ্টাই করি কিছুতেই তাকে মন থেকে ঝেড়ে ফেলতে পারছি না ! এই মনোভার আজ আরও ভারি হল এক আর্মি অফিসারের লেখা পড়ে, যেখানে তিনি তাঁর সঙ্গে গুরগাওঁ-এর কয়েকটি ‘অভিবাসী’ পরিবারের দেখা হওয়ার মর্মস্পর্শী অভিজ্ঞতা বর্ণনা করেছেন : খালি পায়ে, গলন্ত পিচের রাস্তায়, তাঁরা হেঁটে চলেছেন নিজেদের রাজ্য বিহারের দিকে। তিনি বলেছেন ক্ষুধার্ত অবুঝ সেই চার বছরের শিশুর কথা, কেমন করে কান্নায় ভেঙে পড়ে তাঁরা তাঁর পা-জড়িয়ে ধরেছিলেন, যখন তিনি তাদের কয়েকটামাত্র পাঁচশো টাকার নোট দিয়েছিলেন।
২০২০-র এই ভারতে লজ্জায় আমার মাথা নিচু কারণ আমি সেই দেশ সেই সমাজের অন্তর্ভুক্ত যারা লাখো লাখো মানুষকে তাদের দেশ থেকে নির্বাসন দিয়েছে, পাছে তাদের থেকে কোনও ভয়ঙ্কর ভাইরাসের ছোঁয়াচ লাগে। অথচ সেই ভাইরাসের ছোঁয়াচ এঁরা নন, বরং নিয়ে এসেছে উড়োজাহাজে করে দেশে প্রত্যাগত আমারই ভ্রাতৃকুল। আমি লজ্জায় মাথানত করি যখন তাদের বদলে এই অভাগা পদাতিক মানুষের মিছিলকে দায়ী করা হয় রোগ ছড়ানোর অপরাধ-সঙ্ঘটনকারী হিসেবে। আমি লজ্জিত সরকারি আমলাতন্ত্রের বানিয়ে তোলা সমস্ত মিথ্যা ও অর্ধসত্যকে বিশ্বাস ক’রে বোকা-বনে-যাওয়া নির্বোধ মনুষ্যকুলের একজন হিসেবে। মেরুদণ্ডহীন হয়ে, নিষ্ঠুর বেপরোয়া এক দেবীবন্দনায় থালাবাটি বাজানোর প্রচণ্ড শব্দতাণ্ডবে, সুদূর-গাঁয়ের-উদ্দেশে পথচলা মানুষগুলির ক্লান্ত অবসন্ন পদশব্দকে ঢেকে দিয়েছি বলে আমার লজ্জা করে।
যে ধর্ম আমাকে জন্ম দিয়েছে তাকে আর আমি চিনতে পারি না। এই ধর্ম আর ধারণ করে না অতীতকালের সেই ঋষি ও সন্তদের জ্ঞানকে, না সম্রাট অশোকের করুণা বা গান্ধীর নম্র দীনতাকে। এই ধর্ম আজ উপচে পড়ছে বিদ্বেষে, ক্রোধে, ঘৃণায়, হিংসায়। প্রাচীনকালের মহান আদর্শকে এ ঢেকে দিতে চায় বিশালতর মূর্তি নির্মাণ ক’রে, মমতাময় কীর্তিকে প্রতিস্থাপিত করতে চায় মৃত আচার-অনুষ্ঠান দ্বারা । একসময় এই ধর্ম খাদ্য দিয়েছে দরিদ্র ও ভিক্ষুকদের, আর আজ কোনও প্রমাণ ব্যতিরেকে তাদেরই তাড়িয়ে দিতে ব্যস্ত ভয়ানক এক রোগজীবাণু-বহনকারী বলে। এমনকি এই ধর্ম বিশ্বব্যাপী দুর্যোগের এই পটভূমিকায় সুযোগ খুঁজে নেয় অপর ধর্মের নামে অপবাদের কলঙ্কলেপনের ।
আমি আমার মধ্যবিত্ত মানসিকতার জন্য লজ্জিত, আমার এবং আমার বহু বন্ধু, সহকর্মী এমন কি আত্মীয়মহলের মনোবৃত্তির জন্য। গুটিপোকার মত হাউসিং সোসাইটি আর সেক্টরগুলিতে নিজেদের আবদ্ধ করে আমরা নির্বাসন দিয়েছি আমাদের গৃহপরিচারিকা, ড্রাইভার, খবরের কাগজওয়ালা, খাবার-বিলি-করা ছেলেদের এবং আরও ডজনখানেক মানুষকে। মূলত তাদের পিঠে ভর করেই আমাদের এই স্বচ্ছন্দ জীবনযাপন সম্ভব হয়ে উঠেছে, আর আমরা কিনা এখন মরীয়া সেই হতভাগ্যদের ছোঁয়াচ থেকেই নিজেদের বাঁচাতে। তাদের জীবিকা থেকে আমরা তাদের বঞ্চিত করছি। লকডাউনকে দীর্ঘতর করতে আমরা ঘোরতর উৎসাহী কারণ তাতে আমাদের মাইনে বা পেনশনপ্রাপ্তিতে ব্যাঘাত ঘটবে না। বদলে আমাদের দুশ্চিন্তার কেন্দ্রবিন্দু হল অ্যামাজন আর সুইগির খাবার-বিলিকে যাতে আবার চালু করা যায়; লাখো অভিবাসীর চরম দুঃসহ অবস্থাকে তাদের কর্মফল বলেই ভুলে যাওয়া যায় --- যে সমাজ নিজেকে ছাড়া আর কারো জন্যই ভাবে না, এ হল সেই সমাজের সমস্যা এড়ানোর কৌশল ।
লজ্জা বোধকরি আমার শ্রেণিগত চিন্তাধারার জন্য, যে চিন্তাধারা ক্ষুধার্ত মানুষগুলির সাহায্যে দেওয়া ‘অনুদান’-এর বিপক্ষে পোস্ট ফরোয়ার্ড করে হোয়াটসঅ্যাপ-এ; ফিরে-আসতে-চাওয়া শ্রমিকদের একমাত্র আশা MNREGA-র বিরুদ্ধতা করে সাধারণের টাকা নষ্ট করা হচ্ছে বলে; তাঁদের জন্য করা খাদ্যশিবিরের বিরোধিতা করে--- কারণ তাতে সাধারণের ট্যাক্সের অপব্যবহার করা হচ্ছে! আমি লজ্জায় মরে যাই, কারণ আমার মত মানুষরাই পুলিশকে উৎসাহ দেয় ফিরে-আসতে-চাওয়া জনতাকে পিটিয়ে ঢিট করে দেওয়ার জন্য, কেননা তারা লকডাউন মানছে না। আসলে এটা ‘ওদের’ ছোঁওয়া থেকে ‘আমাদের’ রক্ষা করার জন্যই । মরে গেলেও আমি বুঝতে পারি না কেমন করে আমরা এতটা নির্দয় হতে পারি, যে চার-কামরার ফ্ল্যাটে বসে ষোলোজন হা-ক্লান্ত মজুরকে দায়ী করি তাদের নিজেদেরই মৃত্যুর জন্য : যে কেন তারা রেললাইনের ওপর শুয়ে ঘুমোচ্ছিল? কী করে আমি লজ্জা না পেয়ে থাকব যখন শুনছি আমারই স্ব-শ্রেণির মানুষজন অভিবাসী শ্রমিকদের জন্য বাস/ট্রেন চালু করার অর্থব্যয়ের বিরুদ্ধে, তাদের কোয়ারেন্টাইনে রাখার খরচের বিরুদ্ধে চিৎকার করছে? অথচ এরাই নিজেদের লোককে বিদেশ থেকে এয়ার ইন্ডিয়ার উড়োজাহাজে ফিরিয়ে আনাকে সমর্থন করেছে? এ-কেবল পক্ষপাতমূলক চিন্তাধারা নয়, এদের চিন্তাভাবনা আসলে একেবারে দেউলে হয়ে গেছে।
আমার সামাজিক প্রতিবেশ আমাকে লজ্জিত করে যখন তারা ক্রমাগত সেই নেতার মহিমাকীর্তন করে যায়, যে নেতা আমাদের মোট জনসংখ্যার অন্তত পাঁচ শতাংশ মানুষের পর্বতপ্রমাণ অবর্ণনীয় কষ্টকে শুধুমাত্র ‘তপস্যা’ শব্দের উচ্চারণে ফুৎকারে উড়িয়ে দেয়, যেন তাদের সামনে দ্বিতীয় কোনও পথ খোলা ছিল ! একটিমাত্র ভাইরাস কেমন করে আমাদের শিক্ষা ও স্বাচ্ছল্যের, সভ্যতার, ছদ্ম আবরণকে স্তরে স্তরে নগ্ন করছে, দেখে আমি স্তম্ভিত ! আমাদের সামাজিক সমষ্টির অন্তঃস্থল থেকে অন্ধকারতম এক হৃদয়কে এটি বের করে আনছে, যার চামড়ার পরতে পরতে জড়িয়ে আছে সংখ্যালঘু সম্প্রদায়ের প্রতি বিদ্বেষ ও অসহিষ্ণুতা, সহায়সম্বলহীন নিঃস্বের প্রতি ঘৃণা। প্রাচীনকালের যত কুসংস্কার, ধর্মান্ধতা, জাতিভেদ আর অনুদারতার সুপ্ত বীজগুলি আবার মাটি ফুঁড়ে উঠছে একটি রাজনৈতিক দলের সক্রিয় কর্মকাণ্ডে ও সাহায্যে।
আমার লজ্জা হয় মেডেলধারী বেশ কিছু জেনারেল, নৌসেনাপ্রধান ও বায়ুসেনাপ্রধানকে দেখে, যারা এক রাজনৈতিক নেতা হুইসল ফোঁকামাত্র আকাশ থেকে পুষ্পবৃষ্টি আর নৌবহরকে আলোকিত করে তোলার কাজে নেমে পড়লেন। সেই তারাই কিন্তু একটা আঙুলও নাড়ান নি লাখো মানুষের ঐ মিছিলের সাহায্যার্থে। তাদের কি একবারও মনে হল না যে ইন্ডিয়া গেটের আশেপাশে সদম্ভে বিচরণ করার চেয়ে আরও জরুরি কোনও কর্তব্য তাদের আছে দেশের প্রতি? তাদের অসীম দক্ষতা ও বহু-কীর্তিত প্রশিক্ষণ ব্যবহার করে স্থানে স্থানে রান্নার ব্যবস্থা করতে পারতেন তারা ক্ষুধার্ত পদাতিকদের জন্য, শিবিরের ব্যবস্থা করতে পারতেন বৃদ্ধ ও অশক্তদের ক্ষণিক বিশ্রামের জন্য, অন্তত মহিলা ও শিশুদের জন্য জলপথে পাড়ি দেওয়ার ব্যবস্থা তো করতে পারতেন? সীমান্তে বীরত্বের পরীক্ষায় তারা সসম্মানে উত্তীর্ণ ঠিকই, কিন্তু মানবিকতার পরীক্ষায় তারা উত্তীর্ণ হতে পারলেন না।
আমাদের বিচারকদের জন্য আমি লজ্জিত, যারা নিজেদের তৈরি গজদন্ত মিনারে এখন নিজেরাই বন্দী হয়ে গেছেন। বারবার তারা সুযোগ পেয়েছেন কার্যনির্বাহী আধিকারিকদের আদেশ দেওয়ার যাতে উপযুক্ত ত্রাণ ও অন্যান্য সাহায্য পৌঁছয় ঐ হতভাগ্য নির্বাসিতদের কাছে, সুযোগ পেয়েছিলেন যে স্বল্প ক্ষমতা তখনও তাদের ছিল, সেটা কাজে লাগানোর, কিন্তু তাকে তারা বলি দিলেন অসম্মানজনক আপোষের হাড়িকাঠে।
বর্তমান সরকারের জন্য আমার লজ্জার শেষ নেই, কারণ এই সরকার সেই মানুষদেরই পরিত্যাগ করেছে যাদের দেওয়া ভোটে সে আজ গদিতে আসীন। এখন এই অসংগঠিত শ্রমিকরা যখন নিদারুণ সংকটাপন্ন তখন এই সরকার তার বিপুল ক্ষমতা ব্যবহার করে তাঁদের কোনও মানবিক সাহায্য তো করছেই না, উল্টে কেড়ে নিচ্ছে গত পঞ্চাশ বছরে অর্জিত তাঁদের অধিকারগুলি। আমি লজ্জিত সেই আমলাতন্ত্রের জন্য যারা একটা দুর্যোগের সুযোগে দাসে পরিণত করে তাঁদেরকেই--- যাঁরা ইতিপূর্বেই নিঃস্ব, যে তন্ত্র অশিক্ষিত মজুরদের চাপ দেয় অনলাইন ফর্ম ভর্তি করে যাত্রার জন্য নাম নথিভুক্ত করতে, কয়েকশো টাকা (যা তাঁদের কাছে নেই) দাবি করে ট্রেন টিকিটের জন্য, রেশন কার্ড আধার কার্ড দেখতে চায় মাত্র পাঁচ কেজি চাল দেওয়ার আগে, আর এই পুরো সময়টা জুড়েই তাঁদের পিটিয়ে ছাতু করে দেয়। আমি ভীষণ লজ্জিত সরকারের এক জয়েন্ট সেক্রেটারির জন্য যিনি কিনা এই রোগের সংক্রমণের জন্য দায়ী করতে পারেন কোনও বিশেষ সম্প্রদায়কে। এ কোনও অরওয়েলীয় বা কাফকায়িত সরকার নয়, এ এক ক্রোধোন্মত্ত ক্ষিপ্ত সরকার। এই অনুভূতিহীন প্রশাসনের জন্য, এবং যারা এই শাসককুলের বিপুল ভ্রান্তির গুণকীর্তনে ব্রতী তাদের জন্য, কেমন করে কেউ লজ্জিত না হয়ে থাকতে পারে?
লক্ষ লক্ষ এই পদযাত্রীরা একদিন তাঁদের ঘরে পৌঁছবেন, যে কয়েক হাজার মানুষ পথেই মারা যাবেন, তাঁদের বাদ দিয়েই। তাঁদের এমনকি সংখ্যা হিসেবেও উল্লেখ করা হবে না : কোনও শিন্ডলার’স লিস্ট তৈরি হবে না তাঁদের নিয়ে। আর ক্ষমতার কাছে নতজানু আমরা সমষ্টিগতভাবে নিজেরাই নিজেদের পিঠ চাপড়াব। বলব, যাক্, একটা সমস্যার সমাধান অন্তত করা গেছে। আমাদের এই নব্য-উদারবাদী সভ্যতার ওপর ঘনিয়ে ওঠা এক বিপদকে পরাস্ত করা গেছে। তাড়িয়ে দেওয়া গেছে রোগজীবাণু-বহনকারীদের। রোগের গ্রাফের বক্ররেখা এখন সরলরেখায় পরিণত হবে। কিন্তু আরশিতে ফাটল ধরে গেছে, তা কখনোই আর জোড়া লাগবে না। চারণ কবিরা যেমন বলেছেন, দোষ আসলে কোনও গ্রহের নয়, সে বিরাজমান আমাদেরই মধ্যে। অথবা, আরেক মহান চারণ কবি, যিনি আমাদেরই একজন হয়েও এখন ‘অন্যদের’ হয়ে গেছেন, তিনি চমৎকারভাবে যেমন বলেছেন :
“উমর ভর গালিব ইয়হি ভুল করতা রহা,
ধূল চেহ্রে পর, ঔর আইনা সাফ করতা রহা।
এই লেখাটা আসলে কেবল আমাকে নিয়েই নয়— প্রিয় পাঠক, এটা তোমাকে নিয়েও। এসো, ফাটল ধরা এই আরশিতে একবার মুখ দেখো। কী, পাচ্ছ কি লজ্জা, একটুখানি হলেও, আমরা যা হয়েছি সেজন্য? আর একসময়ের এক মহান রাষ্ট্রের হারিয়ে-ফেলা আত্মার জন্য?