তবু অনন্ত জাগে - রজত চক্রবর্তী

দেখছি। স্রোত চলেছে। স্রোত আসছে।জনস্রোত। দাঁড়িয়ে আছি ফুটপাথের একদম ধারে, 'ওঁ শিবায় ট্রাভেলস' এর খোলা শাটারের ভেতর। বাঁদিকে কেদারনাথ ডানদিকে বদ্রিনাথের দেওয়াল জোড়া ছবি। দোকান নয়, ছোট অফিস ঘর। অফিসের সামনে চার ধামে যাবার লোভনীয় রেট চার্ট বড় বড় করে লেখা। সেখানেও মাঝে মাঝে ভীড়ের ঢেউ এসে ঘা দিচ্ছে । স্রোত দু'মুখি। এক মুখ চলেছে। এক মুখ ফিরে আসছে। এক মুখ গঙ্গার দিকে, শুকনো। আরেক মুখ ফিরে আসছে গঙ্গা থেকে, ভেজা। হরিদ্বার । কুম্ভ। গঙ্গাস্নান। ভারতবর্ষ চলেছে। নানা ভাষা। নানা জাতি। নানা রঙ। সব মিলেমিশে এক জনস্রোত। ভালো থাকার স্বপ্ন তাদের চোখের তারায় তারায়। আশা'র কাজলরেখা চোখের পাতায় পাতায় । ভালো থাকার মন্ত্রোচ্চারণ দিকে দিকে।
 লক্ষ, অযুত, নিযুত, কোটি কোটি মানুষ চলেছে। চলেছে কুম্ভে। চলেছে গঙ্গা সাগরে। চলেছে ব্রিগেডে। চলেছে জালিয়ানওয়ালাবাগে। চলেছে চট্টগ্রামে। চলেছে তিয়েনানমেনস্কোয়ার থেকে সাইবেরিয়া হয়ে বলিভিয়ার জঙ্গলে। চলেছে দেশ বিদেশের  চলেছে চলেছে বছরের পর বছর। লুম্বিনি থেকে নবদ্বীপ, জেরুজালেম থেকে বারানসী । যুগের পর যুগ। খয়াটে চেহারা, কোটরে চোখ, দড়ি-পাকানো হাত-পা, নোংরা পোষাক, শুকনো স্তন, কোঁচকানো চামড়া  নিয়ে  চলেছে। কারা এরা! অযুত নিযুত! এদের নাম স্বপ্ন । এদের নাম আশা।
একটা ঘর। ঘরের ছাদ। দাওয়া দিয়ে উঠবে লাউ ডগা। দু'বেলা ভাত আর নুন। মেয়ে-বৌকে তুলে নিয়ে যাবে না কেউ। ছেলে, মরদ কাজে যাবে। শিশুর ঘুনসিতে টুং টুং জীবনের ছন্দ। এই এইটুকুর স্বপ্ন। কোন রকমের দিন গুজরানের আশা। সাদা-কালো-বাদামি এরা হাঁটছে। জমায়েতে হাজির হচ্ছে । উৎখাত হচ্ছে এক দেশ থেকে আরেক দেশে। পৃথিবীর মানচিত্রের প্রতিটি রেখায় এদের পদচারণা । মরছে পথেই। পথেই জন্মাচ্ছে। পথেই প্রেম। পথেই মৃত্যু । গ্রামে গ্রামে। তাদের একটি গ্রামের নাম ভারতবর্ষ ।৭৩ বছর হয়ে গেল স্বাধীন । কে স্বাধীন? কার স্বাধীনতা?
কুম্ভ, গঙ্গাসাগর, ও ব্রিগেড একই মানুষের  জমায়েত। ক্ষয়াটে ও রুগ্ন ঐ কোটি কোটি মানুষের ভীড় । এদের নাম বিশ্বাস। বিশ্বাস এক চরম মৃত্যুর নাম। কারন বিশ্বাস ছাড়া তাদের কিছু সম্বল নেই। অবিশ্বাস করার শক্তি ও তাগদ তাদের নেই। তারা বিশ্বাস করে প্রয়াগে বা গঙ্গা সাগরে পুণ্য লগ্নে স্নান করলে তার মেয়ের বিয়ে হবে, স্বামীর অসুখ সারবে, জমি ফিরে পাবে, ফসল ভালো হবে এই এইসব দিন গুজরানের সাফল্য বিশ্বাস। তাদের বিশ্বাস ব্রিগেডে গেলে বা দিল্লিতে যন্তর-মন্তরে গেলে মাটির বাড়ি র চাল, মাসের চাল, স্বাস্থ্যকেন্দ্রের ওষুধ, মেয়ের মিড-ডে-মিলে আধখানা ডিম, ছেলের কলেজ যাওয়া এই এইসব ছোট ছোট দিন গুজরান হবে হবে একদিন।
৭৩ বছর ধরে হাঁটছে এই ছোট্ট গ্রাম, ভারতবর্ষের পথে পথে। তারও আগে বহু বহু যুগ আগে থেকে এই পথ চলা। শুধু 'নেই' থেকে 'আছে'র দিকে যাত্রা। আর 'নেই'লোকেদের সংখ্যা বেশি বলেই, সংখ্যাটা বহু বহু বলেই আখড়া টু আখড়া ওদের নিয়েই টানাটানি। 'নেই' বলেই যুগে যুগে ভালো থাকার নিদান, দর্শণ । দর্শণে দর্শণে সংঘর্ষ । রক্তপাত। ইতিহাস ।  ওদের 'নেই' বলেই আছে কুম্ভ, আছে গঙ্গা সাগর, আছে ব্রিগেড। ওদের 'নেই' বলেই আছে শান্ত্রী ও মন্ত্রী । ওদের 'নেই' বলেই আছে সরকার ও সরকার দখলের লড়াই। ওদের 'নেই' বলেই ব্রিগেড ছিল, আছে ও ভবিষ্যতেও থাকবে। কুম্ভ ছিল, আছে ও থাকবে।
 কুম্ভ, গঙ্গা সাগর, ব্রিগেড একই মুখ। একই ভীড়। ওরা হেঁটেই চলে। চলেছে। চলেছে। পূর্বেও, বর্তমান, ভবিষ্যতেও এরা হেঁটেই যাবে। যাবে। অনন্তের দিকে অনন্ত যাত্রার অন্তিমে। অনন্ত জেগে থাকে। এক কৃষ্ণ গহ্বর থেকে আরেক কৃষ্ণগহ্বরের দিকে। এই চলাকেই বলি জীবন। দীর্ঘ চড়াই-উৎরাইয়ের বাঁকে বাঁকে আছে এক এক মূর্তি। এতোদূর এসে হেপসে বসে, যেই বলেছে, ' ইহাই ভালো থাকিবার পথ, ইহাই মুক্তি । মানুষ মুক্তি মুক্তি মুক্তি বলে উল্লাসে মেতে উঠল খানিক। আবার হাঁটা। আবার বাঁক। আবার ক্ষণিক যতি। আবার হাঁটা...আবার...আবার...অনন্ত যাত্রাপথ...
অজয় নদীর ধারে বালিতে গোধূলি লুটিয়ে পড়েছে আলতো। স্নান সেড়ে নিচ্ছে বোস্টম-বোস্টমি। গড়িয়ে নেমে এলো আঁধার অজয়ের বুকে। মেলা সাঙ্গ করে অনেকেই চলেছে। ফিরে যাচ্ছে। এসেছিল ফিরে যাবার অঙ্গীকার নিয়েই। সুলেখার দুটি চোখের কোন দিয়ে নেমে আসছে ক্ষীন দুই শাখানদী। থুতনিতে এসে মিলেছে। বালির উপর নির্জনে উর্দ্ধমুখ। গেয়ে চলেছে উদার। আমি বিন্দু বিন্দু হয়ে মিশে যেতে থাকি। মিশে যেতেই থাকি...। গোঁসাই বলল, ঐটাই মুক্তি, মানুষ ছোট ছোট করেই মুক্তি পায় রে... আশা নিভে গেলেই সব হাঁটাহাটি শ্যাষ...। সুলেখা গেয়েই চলে, গেয়েই চলে, রাত গভীর হতে থাকে...

 প্রেমপূজা সাঙ্গ করেছি
          প্রতিমা দিয়াছি ভাঙ্গিয়া
         
            হৃদয় মন্দির দেখ দেখি চাহি
             রয়েছে শূন্য পড়িয়া।

উঠে পড়ি। সুলেখা উঠে পড়ে। নীরব অনন্ত জেগে ওঠে রাঙা হয়ে। ঝোলা নিয়ে মানুষের স্রোতে নামি। হাঁটি। চলি। চলাটাই শুধু বেঁচে থাকা... ভেতরে খুব ভেতরে অনন্তের জেগে থাকা...