আকাশের সব নীল কোলে নিয়ে বসে আছে অরুণিমা। ঐখানে পাতা আছে আসনখানি। এইরকম ভাবার প্রশ্রয়েই গাছে ফুল ফোটে, আকাশে চাঁদ, মৃদ বাতাস, এই সব, সব কিছু চারপাশে হয় বা হচ্ছে বলে ভাবা হল, প্রেম আসে। অথবা প্রেমের অনুষঙ্গ হিসাবে এইগুলির উপস্থাপনা দরকার হয়। অনুপান। সাজসজ্জা।লাগে । এই যে বসে আছি জানালার ধারে। ভোরে। সামনে একটা গাছ আছে। সেখানে ক'টা পাখি আসে। ক'টা কাঠবেড়ালি । এইসব নিয়ে আদিখ্যেতার কোন মানে নেই। আমি দেখি না। আসলে এই যে 'দেখি না' বলছি, সেটাও খুব ভালো ক'রে দেখি না। আমরা দেখাই যে, আমি দেখি বা দেখি না। সবটাই নির্ভর করছে উদ্দেশ্য বিধেয় গপ্নের উপর। যতক্ষণ পর্যন্ত না নজরে পড়ছি ততক্ষণ পর্যন্ত হাত-পা নাড়াচ্ছি, ল্যাজ নাড়াচ্ছি, ঝান্ডা-রুমাল-কাপড়-হাতা-ঝাঁটা সব সব নাড়িয়ে চলেছি। তাতেও না হলে চুল কামিয়ে, সার্ট খুলিয়ে, প্যান্ট ছিঁড়ে, রঙ মেখে এই আমি এই আমি তোর জন্য সেজে উঠছি। তোর জন্যই, বিশ্বাস কর আমার সাঁতার কাটা, পুকুরে নামার আগে দেখে নিতাম ঐ জানালাটা খোলা আছে কিনা ! এ'পার ও'পার ! তোর জন্যই সাইকেল শেখা। চোদ্দ পাক। তোর বাড়ির চারপাশ। তোর জন্যই দূর শাখায় ফুল তোলা। কাঁচা আম। টোপা কুল। সরু পাঁচিল। কোচিং ভোর। তোর জন্যই ক্লাসের পড়া, তোর জন্যই পাশ করা। নম্বর কমেও কলার তুলে হেক্কাগিরী, তোর জন্য । তোর জন্যই সিগারেট, গুরু কলার, ঝান্ডা ধরা, দাস ক্যাপিটাল, পদ্য ঘোর, তোর জন্যই শহরে আজ, ছেড়েছি গ্রাম শিউলি ভোর...তোর জন্যই সবই তোর, সবই তোর বলে হামলে যেই বসতে গেলুম পাতা আসনটিতে... অরুণিমার কোলে সমস্ত আকাশের নীল। অরুণিমা, তোকে এইসব বলছি যখন, তখন তুই পাখির পালক। ফুরফুরে এক সোহাগ হাওয়ায় মেলেই দিলি ডানার ঝলক। এই যে তোর মেলা ডানা, ডানায় ফুটে রামধনু, রোদের ঝলক, এ'সব যদি নাইই দেখি! মিথ্যে হবে ওড়াউড়ি!? এই প্রশ্ন টুপ ক'রে ঝরে পড়ে জানিস, ঐ ঐ পুরোনো বাড়ির জানালা থেকে। এই যে আমার পথ ব'লে বা পথ নয় ঠিক, চলা, চলাও কি বলা যাবে! খুব কি জঙ্গম ছিল! নাকি স্থানুকেই আমরা জঙ্গম ভ্রমে ঘুরে বেড়ালাম। বেড়ালাম মানে - চাবিটা নিয়েছো তো যত্নে?? ফেরার টিকিট খানি রেখেছি সাবধানে ! তোর কাছেই যাবো বলেই ফেরার টিকিট কাটি প্রতিবার। রিজার্ভ করি বসার আসন!কোথাও কী পৌঁছুলাম ! ছিল কোন গন্তব্য আমার! আমাদের! 'ছিল' শব্দটির ভেতরে নোনাধরা লাল ইঁটের বিন্যাস, খড়খড়ি জানালা বন্ধ করে চলে গেছে কেউ...কেউ বা পোষাক ছেড়ে চলে গেছে না ফেরার ভূমে.. ছড়ানো ছেটানো ধুলোবালির পান্ডুলিপি। ছোট স্টিকার মারা আছে সবার কপালে, 'এখানে পোষাক পরে থাকতে হবে'। সর্বদা। অহোরাত্র পাল্টাও আর পরো, পরো আর পাল্টাও, পাল্টাও পরো, পরো... অরুণিমা আকাশের নীল নিয়ে বসে আছে গাছের নিচে। ছায়ায় । ঐ খানে পাতা আছে আসনখানি। জানি। বারবার বহুবার বহু স্থানে স্থানে দেখেছি আমি। অরুণিমা আকাশের নীল নিয়ে বসে আছে। নদীর পাশে। মখমল সবুজ বুগিয়ালে। পাহাড়ের বাঁকে। গ্রামের ভেজা পথের মোড়ে। টালির দাওয়ায় । অরুণিমা এক আকাশ কোল পেতে বসে আছে। আমার আমার বলে, না ফেরার প্রস্তাবনা নিয়ে যেই গেছি পাতা আসনের কাছে ... সর্তাবলি নোটিশ টাঙানো আছে যত্রতত্র...যেমন হয়ে থাকে আর কী! ছবির মতোই। মানে সব বার্তাই দেখানোর...সতর্কতাবিধি। সে'বার বেড়াতে গিয়ে ক্যামেরা গেল বিগড়ে। কোন ছবিই তুলতে না পারার এক ব্যাগ দুঃখে ভেসে গেল পাহাড়, পাহাড়ের ঢালে সূর্যের হেলে পড়া, লাল ফসলের ক্ষেত, পাহাড়ি শিশুর ফাটা গাল, সব সবকিছুই। কি ঘোর বর্ষা মাথার ভেতর, বুকের ভেতর। দেখানোর কিছুই থাকল না! কী দেখলাম তার থেকেও কী দেখাতে পারলাম বা পারলাম না, কী প্রবল লড়াই । কি চূড়ান্ত পরজীবী এই এই সব আমরা বারবার বলি , এসো হাত ধরো। চিৎকার করতে হয়, 'আয় সব বেঁধে বেঁধে থাকি'। কী করুণ উচ্চারণ । স্মরণ। এই অনন্ত চিৎকার, আর্তি একসময় ছিল না, থাকার কথাও নয়, তখন জানালা দরজা হাট, ভয়ে কোন দৈব আদেশে নয়, ভয়ে, ভয়ে সব জড়িয়ে থাকার অভ্যাস আর সেই অভ্যাসে এই এই ডাক। চাতক দেখিনি আমি, চাতক বুঝিনি আমি, তবু তাকিয়ে তাকিয়ে এই বেঁচে বর্তে থাকা আমার মতো করে নয়, তোর মতো, তোদের মতো, তোমার মতো, তোমাদের মতো, তার মতো, তাহাদের মতো,...মতো...মতো আর মতো....বড় চাপ হে এই পরজীবী পরিক্রমা, চলা!! অরুণিমা সমস্ত আকাশের নীল কোলে নিয়ে বসে আছে। আসনখানি পাতা আছে, এই প্রশয়েই কোথাও না কোথাও আমরা হেঁটে চলেছি... পৌঁছেছি কোথাও! না জেনেই ছেড়েছি পোষাক। সব সব ছেড়ে ছেড়ে জীর্ণ, শূন্য টুকু থাক ছাই থেকে তুলে আনি জল একটু একটু ঢালি বৃক্ষতল, হে বৃক্ষতল... অরুণিমা সমস্ত আকাশের নীল কোলে নিয়ে ঐ খানে...