'বিনা যুদ্ধে নাহি দিব সূচাগ্র মেদিনী ' -- এই বাক্যবন্ধ উচ্চারণের পরবর্তী অধ্যায় আমাদের জানা। অবশ্য মাত্র পাঁচখানি গ্রাম পঞ্চপান্ডব দের দিয়ে দিলেই যে কুরুক্ষেত্রের যুদ্ধের আর প্রয়োজন হতনা এমন কথা কেউ বিশ্বাস করেন না। অজস্র অনুরোধ , উপরোধ অথবা বর্ষীয়ান কৌরব প্রধানদের সাবধানবাণী একটুও টলাতে পারেনি দূর্যোধনকে। শেষ পর্যন্ত সেই সময়ের আর্থ-সামাজিক পরিস্থিতিতে পরাক্রান্ত নৃপতিদের ক্ষমতার নতুন বিন্যাসের প্রয়োজনে যুদ্ধ হয়তো অনিবার্য ছিল । দ্রৌপদীর বস্ত্রহরণ , পাশাখেলায় যুধিষ্ঠিরের সর্বসান্ত হয়ে যাওয়া -- এসব হয়তো অনুঘটকের কাজ করেছিল তবে এটাও ঠিক যে কৌরব-পান্ডবদের পরস্পরের মধ্যে যে তীব্র বিদ্বেষ ও হিংস্র প্রতিশোধস্পৃহা ছিল সেটা কখনোই তাদের শান্তিতে থাকতে দিতনা । দূর্যোধন ছিল অপ্রতিরোধ্য এবং কৌরবদের পক্ষের একজনও ছিলনা যার অপ্রত্যর্ক প্রাধিকার ছিল এই ভয়ঙ্কর অসূয়ার নিরসন ঘটানো । তাই আঠারো দিনের সেই রক্তলাঞ্ছিত ভ্রাতৃঘাতী যুদ্ধের ভয়াবহতা, নৃশংসতার বর্ণনা পড়তে পড়তে মনে হয় যুদ্ধ কি তার নিজস্ব নিয়মে শত্রুকে শুধু পরাস্ত করেই ক্ষান্ত হয় নাকি তাকে প্রয়োজনের থেকে অনেক বেশি অমানুষিক নিষ্ঠুর ও নৃশংস করে তোলে। তাই দ্রৌপদীকে অপমানের প্রতিবাদে দূঃশাসনকে সন্মুখ সংগ্রামে নিহত করাই শুধু নয়, তার বুক চিরে রক্তপান করেই ভীমের তৃপ্তি ও প্রতিজ্ঞা পূরণ।
এইরকম ভয়ঙ্কর আরো একটা প্রতিজ্ঞা পূরণের ঘটনা বেশ কয়েকবছর আগে জানা গিয়েছিল যা শুনে শিউরে উঠতে হয় । সিরিয়ার বিদ্রোহীরা নাকি শপথ করেছিলো যে প্রেসিডেন্ট আল-আসাদের বাহিনীর কাউকে ধরতে পারলে তার হৃৎপিণ্ড চিবিয়ে খাবে । তার কিছুদিন পরেই বিদ্রোহীদের হাতে নিহত রাষ্ট্রীয় বাহিনীর এক সৈন্যের মৃতদেহ থেকে সত্যি সত্যিই তার হৃৎপিণ্ড কেটে বার করে তাতে কামড় বসিয়েছিল তারা । ইন্টারনেটে দেখা গিয়েছিল একজন বন্দুকধারী বিদ্রোহী সেনা নিজের হাতে কাঁচা হৃৎপিণ্ড ধরে কামড় বসাচ্ছে , তার মুখ ও ঠোঁটের পাশ দিয়ে গড়িয়ে পড়ছে তাজা রক্তের ধারা এবং তার অন্যান্য সঙ্গীরা উল্লাসে নৃত্য করছে ।
স্বাভাবিকভাবে মনে প্রশ্ন জাগে যে যুদ্ধ মানেই কি পরাজিত দেশে মাত্রাতিরিক্ত অত্যাচার ও নারকীয় ধ্বংসলীলা ঘটানো ? এই প্রসঙ্গে একটা ছোট ঘটনার কথা মনে আসছে । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধে জার্মান বোমারু বিমানের আক্রমণে ধ্বংসস্তূপে পরিণত হয়েছিল স্পেনের গোয়ের্নিকা শহর। সেই আতঙ্কময় ধ্বংসের এক অবিস্মরণীয় ছবি এঁকেছিলেন পিকাসো। যুদ্ধে প্যারিসের পতনের সময়ও পিকাসো ঐ শহরেই থেকে গিয়েছিলেন । নাৎসিরা তাঁকে জানতো কমিউনিস্টদের একজন সহমর্মি হিসেবে ও সেইজন্যে নানাভাবে হেনস্থা করতো। একদিন জার্মান অফিসাররা তাঁর ফ্ল্যাটে তল্লাশি করে একটা ছবি পেল। সেটা ছিল তাঁর একটি বিশ্ববিশ্রুত শিল্পকৃতি। ছবির নাম"গোয়ের্নিকা"। সেই হাড়হিম করা ধ্বংসলীলার ছবি দেখে সবাই চমকে উঠলো। তারা জিজ্ঞেস করলো - এটা কি আপনার কাজ ? পিকাসো চুপ করে কিছু ভাবলেন । তারপর কঠিন স্বরে বললেন - না এটা আপনাদের কাজ।
ইরাকের শাসকের কবল থেকে সেখানকার মানুষদের উদ্ধার করার নামে তার পথঘাট , কসবা , বাজার , মসজিদ গুঁড়িয়ে দেওয়া হয় লাগাতার বোমার আঘাতে । রাস্তা জুড়ে ছড়িয়ে পড়ে থাকে মানবদেহের টুকরো টুকরো অংশ । সেই সময় তিন-চার বছরে আটলক্ষের বেশি মানুষ নিহত হয়েছিল। বার্মিংহাম বিশ্ববিদ্যালয়ের অর্থনীতির শিক্ষক হিসেব করে বলেছিলেন যে সেই অসম যুদ্ধে ইরাকের অর্থনৈতিক ক্ষতির পরিমাণ ছিল চব্বিশ বিলিয়ন মার্কিন ডলার । বিশ্বজুড়ে ইতিহাসের সাক্ষ্য আছে যে পরাজিত ও অসহায় বন্দী শত্রুর ওপর নৃশংস ও অমানবিক অত্যাচার হামেশাই ঘটেছে । দ্বিতীয় মহাযুদ্ধের সময় যুদ্ধবন্দীদের ( pow ) ওপর হিটলারের বৈজ্ঞানিকরা গবেষণার নাম করে তাদের শরীর নিয়ে যে অমানুষিক ও বিভৎস পরীক্ষা-নিরীক্ষা চালাতো তার মর্মান্তিক বিবরণ পরবর্তীকালে সকলেই পড়েছে ।
তবে যুদ্ধ কি মানুষের আদিম হিংস্রতাকে ও ধ্বংসের প্রবৃত্তিকে উসকে দিয়ে তাকে dehumanise করে তোলে । তাই কি একটু সুযোগ পেলেই পরাজিত ও অসহায় বন্দীদের ওপরেও সে ঝাঁপিয়ে পড়ে উন্মত্ত আক্রোশে । কোনো কারণ ছাড়াই খুন , অত্যাচার , ধর্ষণ ও লুণ্ঠন তার একটা মজা । আবার এটাও দেখা গেছে যুদ্ধ অথবা ব্যক্তিগত লড়াইতেও ধ্বংস ও ভায়োলেন্সভরা টাটকা রক্তস্রোত এখন বিনোদনের জগতে চড়া দামে বিক্রি হচ্ছে। সিনেমাতেও দেখা যাচ্ছে ভিলেন মাটিতে পড়ে আর্তনাদ করছে আর তখনই নায়ক হাতে খোলা তলোয়ার নিয়ে তার বুকে বারবার আঘাত করে যাচ্ছে আর ফিনকি দিয়ে রক্তের ফোয়ারা ছুটছে। হলে দর্শকরা উল্লাসে ফেটে পড়ছে , কেউ কেউ সিটি মারছে।
মনে আছে নব্বই এর দশকে টেলিভিশনে গাল্ফ যুদ্ধের লাইভ কভারেজ দেখানো হয়েছিল। ঘরে ঘরে যেন ওয়ার-ফ্রন্ট। অত্যাধুনিক প্রযুক্তির দৌলতে উপসাগরীয় ঘুর্ণিপাক থেকে উঠে আসছে টাটকা ছবি। বাড়ির শিশুদের সঙ্গে আমরা সবাই মিলে দেখেছি কেমন করে হ্যারিয়ার জেট আচমকা বোমা ফেলে চুরমার করে দিচ্ছে রাতের বাগদাদ। ক্যামেরায় দেখা যাচ্ছে অন্ধকারের ভেতর লাল, নীল কমলা রঙের খেলা। সেই সঙ্গে শোনা যাচ্ছে অসহায় মানুষের কান্না , তাদের গগনভেদি আর্তনাদ । মৃণাল সেন একে বলেছিলেন , " অশালীন বেলেল্লাপনা "। অসহায় মানুষের ওপর এই লাগাতার অত্যাচার দেখলে আমাদের অন্তর হয়তো কাঁদে আবার সেই অত্যাচারের দৃশ্য আমরা সবাই বেশ উপভোগও করি । নিদারুণ এই পরস্পরবিরোধী মানসিকতা আমাদের মনোজগতে এক অভূতপূর্ব paradox তৈরি করছে ।
যুদ্ধবন্দীদের ওপর অমানুষিক নির্যাতনের নানা ঘটনার কথা মাঝে মাঝেই বাইরে এসে যায়। যেমন ' দি ব্ল্যাক ব্যানার্স / ইনসাইড দি হান্ট ফর আলকায়দা ' বইটিতে লেখক এফবিআইয়ের প্রাক্তন স্পেশাল এজেন্ট আলি.এইচ.সওফান সন্ত্রাস দমনের নামে অসহায় বন্দীদের ওপর সিআইএ র অত্যাচারের একটা নমুনা দিয়েছেন :
' বিন লাদেনের সঙ্গী আবু জুবেইদা ২০০২ এর মার্চ মাসে ধরা পড়ে পাকিস্তানের ফয়সলাবাদ থেকে। আবু জুবেইদাকে জেরা করার পদ্ধতি নিয়েই তোলপাড় হয় সব মহলে। CIA একটা পদ্ধতি প্রয়োগ করতো যার নাম EIT বা Enhanced Integration Technic । এগুলি হলো ,
১) লাগাতার ঘুমোতে না দেওয়া
২) কালো রঙের ছোট্ট বাক্সের মধ্যে জোর করে পুরে রেখে দেওয়া ।
৩) শৌচাগারে যেতে না দেওয়া ।
৪) শুইয়ে হাত-পা বেঁধে মুখে কাপড় চাপা দিয়ে অনবরত জল ঢেলে যাওয়া যাতে কষ্ট অনুভুতি একদম জলে ডুবে যাওয়ার মত হয় । '
যুদ্ধের উদ্দেশ্য অবশ্যই শত্রুসংহার এবং তাকে পরাজিত করা। যুদ্ধের ইতিহাসের ঠাসবুনোটে কত শত আত্মত্যাগ ও বীরত্বের কাহিনী । একজন সৈনিক রণক্ষেত্রে সেনাপতির নির্দেশ পালন করবে প্রশ্নহীন আনুগত্যে -- এটাই তার ধর্ম । কিন্তু পরাজিত শত্রুসৈন্যের ওপরেও মাত্রাতিরিক্ত জিঘাংসা ও সেইসঙ্গে অমানুষিক হিংস্রতা কি তার পক্ষে অনিবার্য ? যুদ্ধ কি মানবতা বিরোধী ? বর্তমান সময়ের প্রেক্ষিতে যুদ্ধ , হিংস্রতা ও বিনোদন মিলেমিশে একাকার হয়ে যাচ্ছে । এটাই কি আধুনিক প্রযুক্তি-সমৃদ্ধ প্রগতিশীল সভ্যতার ভবিতব্য ?