অনন্তই আধার : বিনয় মজুমদারের কবিতা - গৌতম সাহা

" আমার মনে হয় একালে বাংলাদেশে এতবড় শক্তিশালী শুভবুদ্ধিসম্পন্ন কবি আর জন্মাননি " - ঋত্বিক ঘটক

যারা অনেক জানেন এবং তা জানাতে চান তারা বুঝি উন্মাদের মতো আচরণ করতে থাকেন। নাকি আমরা তার সঙ্গে উন্মাদের আচরণ করি। তাঁর গায়ে ঢিল ছুড়ি --- বিদ্যুতের শক দিয়ে তাঁকে অস্থির করে তুলি --- অথচ তিনি শান্ত বুদ্ধের মতো ধ্যানমগ্ন থেকে আমাদের জন্য যে কবিতা রচনা করেছেন তার বিদ্যুৎপ্রভার ছটা আমাদের মর্মে এসে লাগে -- তিনি আমাদের ঘুম ভাঙিয়ে দেন। তিনি বলতে থাকেন -- বলতেই থাকেন --
যে সব গনিত আমি সমাধান করেছি জীবনে
তারা কি আগেই ছিল জীবন্ত ও কর্মক্ষম, নাকি
আমি তাদের সৃষ্টি করেছি প্রথমে নিজ মনে ?
অথবা,
জল খাব ভেবে আমি জলের গেলাস তুলে দেখি
গেলাসে অর্ধেক ভর্তি জল আছে, এবং সে জলে
কালো কালো পিঁপড়ের মৃতদেহ স্পষ্ট ভাসমান।
এই হল আসলেই জ্ঞান হীনতার ফলাফল
যেহেতু টেবিল থেকে গ্লাস বেয়ে ওঠার সময়
পিঁপড়েরা জানতনা গ্লাসে কী রয়েছে
গ্লাসে যা রয়েছে তাতে পড়লেই মৃত্যু সুনিশ্চিত ---
এইসব জানতনা ওই মরা পিঁপড়েরা
ফলে এই জলে ডুবে মরেছে পিঁপড়ে
তা হল অতি সত্যজ্ঞান হীনতার ফলাফল
আমরা দেবদেবীগণ সবকিছু জানিনা কি ? সবকিছু জেনে বেঁচে থাকা যায় এই সীমাহীন জায়গায়।
‌ বিনয় মজুমদার আমি
জানিনা সকল কিছু; পিঁপড়ের জ্ঞানহীনতার ফল,
পিঁপড়ের মৃত্যু দেখলাম সকালবেলা আজ।"
এমন মর্মভেদী নির্ভার কবিতা তো আমিও লিখতে চেয়েছিলাম। লেখার পর যা দাঁড়ায় তা হল অক্ষম কিছু শব্দপুঞ্জ যাকে দেখলে এই পিঁপড়েরাও মুখ ফিরিয়ে চলে যায়। তাঁর কবিতা পড়তে পড়তে মনে হয় যেন স্বয়ং সময় নিজে এসে দাঁড়িয়েছে এবং পেয়েও গেছে বিনয়কে। আর বিনয়ও জানতেন ঘাড় মটকে নেবে। আর তাঁর মৃত্যু নিশ্চিত। শুধু গনিত নিয়ে থাকলে হয়ত তিনি নিজেকে কিছুটা সামলে নিতেন। কিন্তু গনিত ও কবিতার যৌথ আক্রমণে বিপর্যস্ত বিনয় টাল সামলাতে না পেরে যা লিখেছেন তা হয়ে উঠেছে এই বিশৃঙ্খল সময়ের অনুবাদ। প্রকৃতি যেন তাঁর ভিতর তার পিপাসার নিবৃত্তি ঘটাতে চেয়েছেন। যেদিন সেই কাজ সম্পন্ন হয়েছে তিনি সেদিনই মারা গেছেন (১১ ডিসেম্বর,২০০৬ সকালবেলা)। মগ্নতার অপর নাম তাই বিনয় মজুমদার।

বিনয় শিবপুরে এঞ্জিনিয়ারিং পড়তেন। শোনা যায় তাঁর গনিত বিদেশে সুখ্যাতি অর্জন করেছে। তিনি শিখেছিলেন রুশ ভাষা। তিনি যে কবিতার বই না না কবিতার গ্ৰন্থ লিখেছিলেন তা এরকম --- নক্ষত্রের আলোয় (১৯৫৮), ফিরে এসো চাকা (১৯৬২), আমার ঈশ্বরীকে (১৯৬৪), অঘ্রাণের অনুভূতিমালা (১৯৭৪), আমি এই সভায় (১৯৮৫), শিমুলপুরে লেখা কবিতা (২০০৫), বিনোদিনী কুঠী (২০০৬)। লিখেছেন বাল্মীকির কবিতা। এছাড়াও লিখেছেন ধূসর জীবনানন্দ নামে গদ্যগ্ৰন্থ। তিনি প্রকৃত অর্থেই বাংলা কবিতার জন্য শহিদের মৃত্যু বরণ করেছেন। তিনি কবিতা নিয়ে নানা রকম পুতুল বানিয়েছেন। তা কখনোও অন্ধকারের নাণ কখনো বা নির্জন খয়েরি কখনও তা আবার বিষণ্ণ মহাকাল। বারংবার তাঁর কবিতা জুড়ে গায়ত্রীর ছায়া। হয়তো জেনেছি তিনি কে --- তবু নীরবতার ধুলোবালি দিয়ে তাঁকে কিছুটা ঢেকে রাখি। বিনয়ের রমন আছে, নারী নেই। নারী থাকলে এসব কবিতা পেতাম !
আমরা দুজনে মিলে জিতে গেছি বহুদিন হলো
তোমার গায়ের রঙ এখনো আগের মতো, তবে
তুমি আর হিন্দু নেই, খৃষ্টান হয়েছো
তুমি আর আমি কিন্তু দুজনেই বুড়ো হয়ে গেছি
আমার মাথার চুল যেরকম ছোট করে ছেটেছি এখন
তোমার মাথার চুলও‌ ছোট করে ছাঁটা
ছবিতে দেখেছি আমি দৈনিক পত্রিকাতেই; যখন দুজনে যুবতী ও যুবক ছিলাম
তখন কি জানতাম বুড়ো হয়ে যাব ?
আশাকরি বর্তমানে তোমার সন্তান নাতি ইত্যাদি হয়েছে।
আমার ঠিকানা আছে তোমার বাড়িতে
তোমার ঠিকানা আছে আমার বাড়িতে চিঠি লিখব না।
আমরা একত্রে আছি বইয়ের পাতায়।
হয়তো সুচরিতা কে মনে আসবে আমাদের
তবু এই যে শরীর উপুড় করে লেখা
যে নারীটা তাকে ছেড়ে দূরে জীবনের আরও ব্যাপ্তি ও স্বর্গীয় সৌরভের খোঁজে চলে গেছে তাকে কলমে লিখতে গিয়ে লিখেছেন না যুবক ও যুবতী --- লিখেছেন যুবতী ও যুবক এমন মর্মরধ্বনি খুব কি বেজে উঠেছে বাংলা কবিতায়! অনুভূতির তীব্রতা ও পরিমিত বোধের গাঢ়তা না থাকলে এমন গূঢ়তা কীভাবে সম্ভব।
আকুতি তাঁর ছিলোই --- নইলে---
আমি মুগ্ধ, উড়ে গেছো, ফিরে এসো চাকা,
রথ হয়ে, জয় হয়ে চিরন্তন কাব্য হয়ে এসো‌
আমরা বিশুদ্ধ দেশে গান হবো,প্রেম হবো,অবয়বহীন
সুর হয়ে লিপ্ত হবো‌ পৃথিবীর সকল আকাশে

প্রত্যেক শিশুই কিছু জ্ঞান নিয়ে মাতৃগর্ভে থাকে
প্রত্যেক শিশুই এই জ্ঞান নিয়ে মাতৃগর্ভ থেকে বেরিয়েছে,
প্রমান : প্রত্যেক শিশু জন্মেই মায়ের দুধ পান করে চুষে চুষে, দেখি
সদ্যোজাতকের এই, সদ্যোজাতিকার এই ক্রিয়া দেখে এইসব বোঝা যায়
এক খিদে লাগলেই তাকে খেতে হবে, দুধ খেতে হবে তাকে
দুই, ঠোঁট দিয়ে চুষে চুষে তাকে খেতে হবে--- এটা শিশু জানে

এমন দার্শনিক বীক্ষা এসেছে এভাবে বাংলা কবিতায়--- বিশ্ব কবিতায়!
এতসমস্ত কিছু তিনি লিখেছেন যে সামান্য দু-চারটি পংক্তি তে তাঁকে ধরা প্রায় অসম্ভব। তবু তুলে আনি -- ক: মানুষ নিকটে গেলে প্রকৃত সারস উড়ে যায়।
খ: ক্ষত সেরে গেলে ত্বকে আর পুনরায় কেশোদ্গম হবেনা।
গ: সকল ফুলের কাছে এতো মোহময় মনে যাবার পরেও
মানুষেরা কিন্তু মাংসরন্ধনকালীন ঘ্রান সবচেয়ে বেশি ভালোবাসে।

একদিকে বৈজ্ঞানিক অনুসন্ধিৎসা অন্য দিকে কাব্যবোধের নিবিড় সংশ্লেষ তাঁর কবিতাকে মহাকালের দিকে নিয়ে গেছে। তাঁর বন্ধু উৎপলকুমার বসু লিখেছিলেন -- " কখনো, খুব তাড়িত অবস্থাতেও বিনয় কে দেখিনি অন্যের বশ্যতা স্বীকার করতে। জীবনের শেষ দিন পর্যন্ত তিনি সামান্য একটুও মাথা নোয়াননি। কাউকে ভয় পাননি। পরবর্তী প্রজন্মের কবিদের এই বিশাল ব্যক্তিত্বের কাছে আর কিছু না হোক, অন্তত এটুকু শিক্ষনীয় হতেপারে।" অথচ কী অপরিসীম দারিদ্র্য! পাঠককে তন্ময় করে দিয়ে তিনি লেখেন--
অভিধানে যতগুলি শব্দ আছে সেসকল আসলে জীবিত
জীবন বিশিষ্ঠ স্বত্তা, হয়তো হুবহু এই বকুলের মতো
বকুলের আকারের মত এক নারী আছে -- শঙ্খমালা আছে
জীবন রয়েছে তার, উড়ে উড়ে নেচে নেচে কত গান গায়।

অন্তরের আর্তনাদ এভাবেই ভাষা পায় তাঁর কবিতায়। আমরা হাঁটু মুড়ে তাঁর কবিতার কাছে বসি। আর পড়ি সেই অমোঘ উচ্চারণ --
অভিজ্ঞতা থেকে ক্রমে আকাশের বর্নহীনতার
সংবাদের মতো আমি জেনেছি তোমাকে,বাতাসের নীলভতাহেতু দিনে আকাশকে নীল মনে হয়।

কবিরা তো শুধু চেনা শব্দ দিয়ে কবিতা রচনা করেন না। অনেক ক্ষেত্রে নতুন শব্দ তৈরি করেন এবং পরবর্তীকালে তা গৃহীত হয় অভিধানে। রবীন্দ্রনাথ এমন অনেক শব্দ তৈরি করেছিলেন‌। এই মুহূর্তে মনে আসছে রোদসী শব্দের অনুষঙ্গে ক্রন্দসী শব্দের প্রবর্তনা -- জীবনানন্দের আকাশলীনা। একই রকম ভাবে বিনয়ও এই কাজ টি নিভৃত মননে করে গেছেন। তিনি লিখেছিলেন -- ' একটি নিড়িহা পাখি আমার বাগানে ' - এই 'নিড়িহা' নামে কোনো পাখি পৃথিবীতে নেই। কিন্তু তিনি এই পাখিকে জন্ম দিলেন।
আরও অনেক শব্দ যেমন - 'লক্ষাব্দী', 'মহাসহস্র', 'মনোলীনা', 'তারাত্ব', 'চলত্ব', 'গমত্ব' ইত্যাদি।

তাঁর কবিতা দিয়েই আমাদের তর্পণ সারি --
পাহাড়ের বড় ছায়া দীর্ঘ হয়ে দূরে চলে যায়
মনে হয় কিছু খোঁজে, আগের রাতের কথা‌ আগামী রাতের কথাগুলি

আমরাও খুঁজি আপনাকে পুনরুজ্জীবনের আকাঙ্ক্ষায়। মহাবিশ্বে-মহাকাশে একাকী যিনি ভ্রমণ করলেন আর নিজের সঙ্গেই কথা বলে গেলেন নিরন্তর। সেই বিস্ময়কর প্রতিভাকে আমরা যে সেভাবে বুঝতে পারিনি তার কারণ আমাদের মধ্যে আরও একজন বুদ্ধদেব বসুর প্রয়োজন ছিল। এমন দু-একজন কবিকেই তো পৃথিবী নিজের করে খুঁজে নেয়।