ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীর রূপকথার দেশ সেই কবে, মনের এক গোপন কুঠুরিতে তালা চাবি দিয়ে বন্ধ করে রাখা আছে। দরজাটা আজও আবছা দেখা যায় কিন্তু সেখানে পৌঁছনো অতি দুরূহ ব্যাপার। সেই ফেরার রাস্তাটি বেঁকেচুরে এমন জটিল জালের আকার নিয়েছে যে, সেপথে হাঁটতে গেলে রাস্তা ভুল হয়ে যায়; তাই ইচ্ছে থাকলেও ফেরা হয় না। দেশ তো স্থাবর। সে নড়েও না, তাকে সঙ্গে বয়ে বেড়ানোও যায় না। তবে, সেই দেশের সীমানা ছাড়িয়ে, এত বছর ধরে এত রাস্তা পেরিয়ে এসে টের পেলাম- আমি এতকাল হাঁটিইনি, কেবল ভেসেই চলেছি; আর সেই বন্ধ কুঠুরি থেকে কখন বেরিয়ে এসে রূপকথার ময়ূরপঙ্খী নাও, আমায় তার পিঠে চাপিয়ে ভেসে চলেছে...
এ নৌকায় সওয়ার হয়ে, একবার নদীর গায়ের ঘামে নুনের গন্ধ পেলে, বোধহয় আর থামা যায় না- অনুভব করলাম লিখতে বসে। গল্প লেখা। ছোট ছোট ঢেউয়ের মতন গল্প। সেখানে গড়া আছে, স্রোত আছে, শব্দ আছে, ভেঙে ছড়িয়ে যাওয়া আছে। খাতার বুকে কলমে টানা স্রোতের দাগ। জীবনজলের দাগ। এই দাগ আঁকতে ময়ূরপঙ্খীই শিখিয়েছে। ঘুম ভাঙা থেকে সেই যে সে আমায় নিয়ে ভাসা শুরু করে, তারপর থেকে থেকে আমায় প্রশ্ন করে,
"ও মন, এখন তুমি কী দেখো?"
-"দাবানলের মত দুঃখ দেখি
জোয়ারের মত যন্ত্রণা দেখি
ছাতুর সরবতের মত সুখ দেখি...."
"শুধু দেখো? পাও না?"
-"পাই।"
"কী পাও? কী পেলে?"
-"চোখের ভেতর কাঁকর পেলাম
বুকের ভেতর কাঁটা পেলাম
মনের ভাঁজে বেদনার সুখ পেলাম..."
অঞ্জনিপুত্রের গতিতে নাও ভাসতে থাকে। বলে না কিছু। তারপর গ্রীষ্মের চণ্ডালডাঙা পেরিয়ে, বর্ষার জলাভূমি পেরিয়ে, শরতের সাদা মেঘের টুকরো সাঁতরিয়ে, ভেসে চলে ময়ূরপঙ্খী...
"ও মন, কী দেখো?" সে জিজ্ঞেস করে আমায়!
-"বনমালীর ঘাট।"
"কী হয় সেখানে?"
-"গান গেয়ে ভিক্ষা হয়। ফকির বনমালী। ট্রেনে ট্রেনে গান গায়।"
"আর কি কিছু দেখা যায়?"
-"যায়। দারিদ্র্যের ঘাট। সেখানে জন্মবিকৃত ভিখারি দেখি, দেহাতি কুলি দেখি, সাঁওতাল কামিন দেখি। সে ঘাটের সিঁড়িতে স্বপ্নের মৃত্যু দেখি... রিকশাওয়ালা, ঠেলাওয়ালা, ন্যাপথলিনের হকার, রঙিন চুড়ির ফেরিওয়ালা, ইতিহাস আওড়ানো গাইড, ফ্ল্যাটের নাইটগার্ড, পরিযায়ী শ্রমিক...."
"মন, আর কী দেখো?"
-"দেখি না। দেখা ছাপিয়ে শুনি।"
"কী শোনো?"
-"প্রান্তরের গান শুনি। খড়ের আটচালার খোঁদলে ধুকপুক করা হৃদয়ের আজান শুনি। ভেঙে পড়া টিনের দেওয়ালের খসখসে কাহিনী শুনি- আর স্রোতের শব্দ শুনি। যে স্রোত এইসব মানুষদের করুণ দরজা ছুঁয়ে, কলমের কালি হয়ে, সাদা পাতার কোলে এসে কেঁদে ফেলে। আমি শুনতে পাই অনাদি ভ্রমণের নদীগোত্র পায়ের শব্দ। একটা অকিঞ্চিৎকর হৃদয় থেকে আরও এক নামহীন হৃদয়ের যজ্ঞপিঠে, হেঁটে যাওয়ার অবিরল সঙ্গীত। ভাটিয়ালি। ভাওয়াইয়া। ঘুঙুরের শব্দ পাই। কে যেন জন্ম-জন্মান্তর ধরে নেচে নেচে গাইছে-
কোথায় পাব তারে!"
"আর কী অনুভব করলে?"
-"প্রেম। যে প্রেম মহাকাশের থেকেও ব্যাপ্ত। কল্পনার থেকেও সুন্দর। বোধের থেকেও গভীর। সে ভালোবাসা ধূপের মত সামান্য, কিন্তু তার সুরভি অনন্ত। যে ভালোবাসা বটগাছের ঝুরির ফাঁক দিয়ে আসা বাতাসের মত শীতল। প্রেমিকার চাহনির মত নরম। যে ভালোবাসা ছুঁয়ে জীবনের প্রতি অটল আস্থায়, এক মুঠো চাল হাতে, প্রাণের শপথ নিয়ে হেঁটে যায় প্রান্তিক না-মানুষেরা। তাদের সঙ্গে উচ্ছিষ্ট খুঁটে খেয়ে হাঁটে নামহীন কুকুর, বেড়াল, গরু, পাতিহাঁস। সকলের বুকে টের পাই একটাই বিশ্বাস- অমরত্ব! জীবনের স্পন্দন আজীবন অমর..."
লিখতে বসে টের পাই, সাদা পাতার সমুদ্ররেখা ধরে ভেসে চলেছে আমার ছোট্টবেলার ময়ূরপঙ্খী নাও। তার পিঠে বসে, তাদের সুখ-দুঃখের গল্প বলছে আমায়, আমার গল্পের চরিত্ররা। আমার বড়বেলার ব্যাঙ্গমা-ব্যাঙ্গমীরা। স্রোতের আওয়াজ আসে আমার কলম থেকে... কোথাও আনন্দলহরী বেজে চলে অবিরাম...