তিনকন্যা ও লকডাউন - যশোধরা রায়চৌধুরী

লম্বায় কুড়িফুট আর চওড়ায় দশফুট একটা বেশ বড় খাবার কাম বসার স্পেসের শেষ জানালাটিকেও বন্দছন্দ করে শশিবালা ভাতঘুম  ঘুমুতে গেলেন। গ্রীষ্মে গরম হাওয়া আর শীতে উত্তুরে হাওয়া, দুইই এই জানালা দিয়েই ত প্রবেশ করে কিনা।

শশিবালার মনটার মতই তার ঘরটাও চাপা চাপা। জানালাগুলো সারাক্ষণ বন্ধ রখা তার চিরদিনের অভ্যাস। যখন মফস্বলের চার বাই সাত ভাড়ার ঘরে থাকতেন, বাঁকাচোরা একটুকুনি স্পেসে রান্নার আয়োজন করতেন, তখন উনুন নেবার ভয়ে হাওয়া আটকাতেন কার্ডবোর্ড দিয়ে । একতলা বাড়িতে চোরে হাত ঢুকিয়ে গলা থেকে হার ছিনতাই করবে তাই রাতে জানালা দিয়ে শুতেন। জৈষ্ঠ্যমাসেও । সেই দমচাপার অভ্যাসখানি এমন রয়ে গিয়েছে, এখনো , শহরতলির ফাঁকায় তৈরি এই ফ্ল্যাটটিতেও সেটাকেই পাশবালিশের মত জড়িয়ে থাকেন। একদা বয়স কম ছিল, গোড়ালির থেকে কাপড় উঠে যাবে ভাবলেই মনে চলকে উঠত গুরুজনদের ভয়। সেই সময়ে সামান্য দুপুরের ঘুমের সময়েই দোর দিতেন শোবার ঘরে। এখন শাশুড়ি হয়েছেন ঠাকুমা হয়েছেন, এখনো  এমনকি নিজের ঘরের দরজা বন্ধ রাখাটাও নিজের অজান্তেই  হয়ে যায়। স্বামীর মৃত্যুর পর একা এভাবে শুলে,  ছেলেরা খুব রাগ করে।

ওদিকে ছেলের বউদের একজন টি শার্ট আর ঢলঢলে পাজামা পরে থাকে, অন্যজন ত ম্যাক্সি উঠিয়ে কোমরে বেঁধে প্রায় হাঁটু অব্দি খুলে রাখবেই যখন তখন। পড়বি ত পড় শশিবালার চোখে। বগল দেখা যাওয়া ম্যাক্সি। কোন লাজলজ্জা নেই।

ঘরে ঘরে সন্ধেবাতি আর ধূপকাঠি দিতে দিতে চোখে পড়ে যায়, ছোট বউ শম্পা আবার খাবার ঘরের জানালাগুলো সব হাট করে খুলে পর্দাও তুলে দিয়েছে। সত্যি শম্পাটার যে কী গরমের বাতিক। এত বে- আব্রু অভ্যাস সব।

সন্ধেবেলা ডগডগিয়ে আলো জ্বেলে রাখবে ঘরে ঘরে। অথচ , এমনি সময়ে, কোন পড়াশুনোর কাজ না থাকলে, ঘরের  সব আলো নিভিয়ে একটা ছোট্ট আলো জ্বেলে রাখা, ঘরটাকে আলো আঁধারিতে ভরিয়ে দেওয়া, এটাও শশিবালার আর একটা বাধ্যতা।  এক সময়ে ত খুব মাইগ্রেনে ভুগেছেন। সেই সময়কার অভ্যাস।

লকডাউনে এমনিতে শশিবালার বিশেষ  অসুবিধে হয়নি , সারাজীবন বন্দী থাকাই ত তার স্বাভাবিক নিয়তি ছিল। প্রথমে স্বামীর জন্য সকালে ঠিক সময়ে ইশকুলের ভাত বাড়া, তিনি যখন খেতে বসেছেন তখন পান , সঙ্গে মাথার খড়খড়ে অংশ ছিঁড়ে পরিষ্কার করা দুটি লবঙ্গ রেডি করে হাতে ধরে রাখা। রান্নায় নুন কম হলে , পানে চুন বেশি হলে স্বামীর গঞ্জনা খাবার জন্য প্রস্তুত থাকা। ভ্রুকুঞ্চনের ভয়ে থাকা।

তারপর পনেরো বছর কাটল দুই ছেলেকে মানুষ করতে, তাদের ইস্কুল, তাদের টিফিন,  তাদের পোশাকের ছেঁড়া বোতাম সেলাই, তাদের হোম ওয়ার্ক। তার জের তারপর আর থামেনি। বড় জন এখনো মা বলতে অজ্ঞান। নিজের জামাকাপড় আর কোনদিনই খুঁজে পায়নি।

 এর পর ছেলেদের বিয়ে, তারপর , পরের পর  দুই নাতিনাতনির জন্ম, তাদের কাঁথা তাদের কোল দেওয়া, তাদের দুধের বোতল ফোটানো। বউরা জানেই বা কী আর পারেই বা কতটূকু। তাই শশিবালারই জন্ম কেটে গেলে ওদের  দেখভালের জন্য। তারা বড় হলেই কি রক্ষে আছে। বউমারা চাকরি করে, তাই  যতদিনে  নাতি নাত্নিও ইস্কুল ছেড়ে কলেজ না যাচ্ছে, রোজ সকালে তাদের মাছের ঝোল ভাত মেখে গরাসে গরাসে খাইয়ে যেওয়া ছিল শশিবালার কাজ। তারপর তারা বড় হল , চলে গেল বাড়ি ছেড়ে অন্যত্র। ততদিনে  শশিবালার স্বামী পড়লেন অসুখে। একেবারে পাঁচ বছর বেডরিডেন। সে পাঁচবছর ত কোথাও বেড়াতে যান নি, পার্কে হাঁটতেও না। আয়নার সামনে গিয়ে দাঁড়ান নি, চুল আঁচড়ানো দূর কথা।

স্বামীর মৃত্যুর পর, এবার তিনি একা। ভেবেছিলেন তীর্থে যাবেন। তা এসে গেল লকডাউন।  এবার লকডাউনের আগে, বড় ছেলে সপরিবারে বেড়াতে গিয়ে আটকা। শম্পা আর টিকলু, মানে  ছোট ছেলেকে নিয়ে শশিবালা  আটকা। নাতনী আটকে গেছে হায়দ্রাবাদে, নিজের চাকরির জায়গায়।

কিন্তু ছেলের মুখ ঝামটা আর ভাল লাগেনা। সারাক্ষণ কেবল হাত ধোও আর হাত ধোও।



রোজ বিকেলের দিকে কেমন অস্থির আর অসুস্থ লাগে শম্পার। রোজ একবার করে মনে হয় , জ্বর আসছে। প্রতিদিন মনে হয়, আজ বোধ হয় আর করোনা থেকে বেঁচে ফেরা হল না।

আপিস যাওয়ার পথে ভয়, আপিস গিয়ে ভয়, আপিস থেকে ফিরে অসংখ্য কাজ , ঢুকেই জামাকাপড় মুখোশ সব সাবান গরমজলে চোবানো, জুতোটা অব্দি ক্লোরিনের জল দিয়ে ধোয়াধুয়ি, অফিসে নেওয়া সব জিনিস স্যানিটাইজার বুলানো।

ফোনে স্যানিটাইজার, আধার কার্ডেও!

তবে কিনা, টাকার ব্যাগ, শৌখিন হাত ব্যাগ, নেওয়াই ছেড়েছে সে। কী দরকার। একটা প্লাস্টিক পাওউচে ফোন, অন্য প্লাস্টিক পাউচে এক ফ্লাস্ক চা। ব্যাস।

আপিস গিয়ে আগে বিলাস ছিল , সুখ ছিল চা খাওয়া। মাল্টি টাস্কিং স্টাফ অরুণের হাতের চা। সে সুখ ত গেছেই, মুখোশ খুলে জল খেতেও অনীহা যেন। সারাদিনে জল না খাওয়াটাও ত ঠিক নয়। বাথরুম ইউজ করতেও ভয়।

বাড়ি এসে স্নান করে সব সেরে খেতে বসে শম্পা , প্রায় পাঁচটায়। আজকাল আপিসে পুরো দিন থাকেনা সে, এইটুকুই যা। তবে পাঁচঘন্টা থাকলেও আট ঘন্টার কাজ পুষিয়ে দিতে গিয়ে নাজেহাল।

খেতে বসার সময় সে দেখে , শশিবালা খেয়ে উঠে যাবার সময়ে সমস্ত জানালা বন্ধ করে গেছেন। বন্ধ ঘর, বন্ধ বন্ধ ঘর।

এ বাড়িতে দম আটকে আসে শম্পার। বিয়ের পরদিন থেকেই। আজো সেই শ্বাসরোধী অনুভূতি গেল না।

খুব আওয়াজ করে করে শম্পা জানালাগুলো খুলে দেয়। ফেস মাস্ক এর ওপর ফেস শিল্ড পরে অফিস যেতে যেতে তার যেমন নাভিশ্বাস উঠে যায়। অজস্র টাকা দিয়ে সে আপিস যাবার জন্য প্রাইভেট গাড়ি ভাড়া করেছে। তাও যেন প্রতি মুহূর্তে মনে হয় কোথা থেকে করোনাভাইরাস এসে তার অ্যায়সি কি ত্যায়সি করে দেবে।

অথচ বিয়ের পর গত পঁচিশ বছর তার শাশুড়ির পাগলের মত শুচিবায়ুগ্রস্ততা, সব রান্নাঘর আগলে রাখা, সারাক্ষণ জানালা দরজা বন্ধ করার বাই, ঘরের আলো পাখা নিভিয়ে যাওয়ার বাই, এইসবের ভাইরাস সহ্য করে করে তার ত নতুন করে দম বন্ধ হবার কিছু ছিল না!

ভাতের সঙ্গে সে অ্যালুমিনিয়াম ফয়েল থেকে শুক্তো নিয়ে টেস্ট করে দেখে। অসাধারণ রান্না। তারপর ঝিঙে পোস্ত। পাশের বাড়ির অনিতা রেঁধেছে।

এই একটা ভাল জিনিস হয়েছে এবারের লক ডাউনে। তারা খুব খুশি এ ব্যবস্থায়। অনিতার কেটারিং এর ব্যবসা তার ও শশিবালার দরাজ অর্ডারিং এর ফুলে ফেঁপে উঠেছে। শশিবালার এ বয়সে আর উনুনের সামনে না যেতে হয়, শম্পার অফিস ও খুলে গিয়েছে, তাই , অনিতাই এখন ভরসা।



অনিতা রাঁধছিল। কী ভীষণ মন দিয়ে সে রান্নার ভেতরে নিজেকে মিলিয়ে মিশিয়ে দেবে যেন। যেন সে তুলি হাতে কোন শিল্পী, রং নিয়ে মশগুল। সেভাবেই মাছের ঝোলের আগে জিরে ধনে হলুদ কাঁচা লংকা মরিচ বাটা কষতে থাকে, টমেটোর লাল আর কাঁচা লংকার সবুজকে নিজের অন্তরাত্মার সঙ্গে মিশিয়ে মাখিয়ে নেয়।

কাল পাশের বাড়ির শশিমাসিমা বললেন, ঝিঙে পোস্ত করতে পার? সে লাফিয়ে উঠল, লুফে নিল যেন প্রস্তাবটা। হ্যাঁ মাসিমা করে দেব। যদিও পাতলা গোলাপি কাগজে লেখা তার কেটারিং এর মেনুকার্ডে নেই ওটা । তবু।  রাঁধতে আমার ভীষণ ভাল লাগে মাসিমা।

ঝিঙে পোস্ত বেশি করেই রেঁধেছে অনিতা। বাবার জন্য এক বাটি রাখল। বাবা বাজার করে এনেছে সকালে। মুখোশ পরে। মেয়ের ব্যবসার জন্য বাবাই মূল উদ্যোক্তা । অশীতিপর কমলবাবুর এখন মেয়ের কেটারিং টাই ধ্যান জ্ঞান।

আজকাল বাড়ি বয়ে মাছ নিয়ে আসছে মাছ ওয়ালারা। সেদিন অপটু হাতে আঁশ ছাড়াচ্ছিল ছেলেটা। ঠিক ধরে ফেলেছেন কমলবাবু, অ্যাই ছোকরা, তুই ত মাছ ব্যবসায়ী নোস। কী কাজ করতিস বাবু লকডাউনের আগে?

চমকে উঠে হেসে ফেলেছিল ছেলেটা। দরজির কাজ বাবু। অ্যাকন ত আমাদের মত অনেকেই মাছ সব্জির বিজনেস করতেছি। সাইকেলে অ্যালুমিনিয়ামের ঘড়া বসিয়ে বাড়ি বাড়ি দোরে দোরে ঘুরে পেট ত চলি যাতিছে।

এই আমার গামলায় কাটা মাছ ঢেলে দে, আগে ফ্ল্যাটের বাইরের কলে ধুয়ে তবে ঘরে নেব। তোর ঐ প্লাস্টিক আমি নেব না।

আচ্ছা বাবু, আমার দুটো চিকিমিকি বেঁচে গেল।

অনিতা ঝুঁকে পড়েছে কড়াইয়ের ওপর। কপালে একটি পাকা চুল চোখের সামনে এসে ঝোলে। ওর বর,তড়িত মারা যাবার পর শ্বশুরবাড়ি থেকে চলে এসেছে অনিতা। ওদের শরিকি বাড়ির একটা ঘর, একা সেখানে থেকে কী হত। যদিও জায়গাটা খুব ভাল। বৌবাজারে তড়িতের পৈতৃক বাড়ি।

ঐ ঘরটার ভাড়া থেকে অনিতা চালিয়ে নিত, কিন্তু এসে গেল লকডাউন। মিউটেশন এর ঝামেলা , শ্বশুরবাড়ির সবার সঙ্গে কথা বলা, দলিল দস্তাবেজ, এইসব ত অনেক সময় নেয়। আবার লকডাউন উঠলে দেখা যাবে খন।

আপাতত এই কেটারিং টা চলুক।

কড়াইতে জল ঢালতেই ছ্যাঁত ছ্যাঁত করে যে আওয়াজ ওঠে, তা অনিতার বুকেও যেন একটা ঠান্ডাভাব এনে দেয়।

লকডাউনে অনেক বাড়িতেই রান্নার লোক নেই। এই সময়টায় কেটারিং এর আইডিয়াটা মোক্ষম ছিল।