বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর যে-কোনও ছবিতেই ক্ষতসময়কে স্পর্শ করার প্রত্যক্ষ তাগিদ থাকে। বিশেষ করে তাঁর ‘ফেরা’ পর্বের ছবিগুলিতে এই বিপণনসর্বস্ব সময়ের সঙ্গে হৃদয়বান মানুষের সংঘর্ষ খরতরভাবে ধরা পড়েছে। এই যুদ্ধে মানুষ ক্ষতবিক্ষত হয়, কিন্তু শেষ পর্যন্ত হার মানে না। এই পর্বের সবগুলি ছবির ভাষ্য তাই। ‘ফেরা’য় বিধ্বস্ত যাত্রাশিল্পী, ‘বাঘ বাহাদুর’-এ বিপন্ন লোকশিল্পী, ‘চরাচর’-এ পাখিপ্রবণ মানুষটি, শেষ পর্যন্ত, নিজের অনুভবের প্রতি, শিল্পের প্রতি দায়বদ্ধ থেকে যায়। ‘ফেরা’ বা ‘বাঘ বাহাদুর’-এর চরিত্র দুজন যে অর্থে শিল্পী, ‘চরাচর’-এর নায়ক সেভাবে নয়, কিন্তু অনুভূতির লালন ও কল্পনায় সে-ও রচনা করে চলে শিল্পেরই অন্য এক প্রকরণ। তার মাধ্যম পাখি। পাখির প্রতি সর্বস্ব মমতায়, স্নেহে-স্বপ্নে-আলোড়নে সে অন্য সবার থেকে বিশিষ্ট। একজন কবি যেভাবে একক, সেও তাই। ছবির শুরুতেই সমুদ্রবিস্তারে অসংখ্য ডানা আর এই ছন্দের সঙ্গে মিল দিতেই যেন, তারপরেই, প্রস্তুতির মতো একটি খাঁচা, ভেতরে একই রকম চঞ্চল, উচ্ছ্বসিত পাখির গুচ্ছ এবং একটি অবধারিত হাত সন্তর্পণ মমতায় একটার পর একটা পাখিকে মুক্ত করে, পরের দৃশ্যবিন্যাসে সেই হাত মুক্ত পাখিগুলিকে ভোর-হয়ে-আসা আকাশে ভাসিয়ে দেয়। প্রসঙ্গটি এবং সেই সঙ্গে দৃশ্যের অভ্যন্তরীণ মিলটিও, সম্পূর্ণ হয়।
ছবিতে পাখিদের প্রতি লক্ষীন্দরের অনুরাগের বিপরীতে রয়েছে প্রায় সবাই --- তার স্ত্রী, সঙ্গী ভূষণ, অবশ্যই কারবারী শাসমলবাবু, কালিচরণ। শুধু ভূষণের মেয়ে গৌরী, ইতস্তত লাবণ্যে ও সহমর্মিতায়, আলাদা। ‘তুমি যখন ধরা পাখি উড়োয় দাও আমার দেখতে ব্যাশ লাগে’। তোমারে যেন এ ছাড়া অন্য কিছু মানায় না। তোমার মুখটা কেমন যেন সোন্দর হয়ে ওঠে’--- একথা যখন বলে গৌরী, নিছক আত্মীয়তাই নয় শুধু, অনুগত অনুরাগেরও স্বর শোনা যায় এবং আরও পরে, যতটা সরাসরি বলতে পারে কোনও নারী :
‘গৌরী : একটু দাঁড়াও।
লক্ষীন্দর : কী বলবি?
গৌরী : সারিদি যদি আর না ফেরে। তুমি বাবারে কয়ে আমারে...’
এই অকুন্ঠ অসমাপ্তি, তার দ্রুত চলে যাওয়ায় সবটাই বোঝা যায়, কিন্তু প্রতিক্রিয়ায় লক্ষীন্দর আশ্চর্যরকম স্তব্ধ। শুধু উপায়হীন বিষন্নতায় তাকিয়ে থাকে গৌরীর চলে যাওয়ার দিকে। কিছুদিন পর, গৌরী, পালকিতে চেপে নির্মম গন্তব্যের দিকে চলে যায়।
গৌরীকে যে গ্রহণ করতে পারল না লক্ষীন্দর, তার কারণ কী? সে কি সারির ফিরে আসায় অস্পষ্ট আস্থা রেখেছে তখনও? অথবা সারি ও তার মধ্যে যে অপূরণীয় দূরত্ব বাড়িয়ে তুলছিল তার পাখিপ্রবণতা, তা যে কোনও নারীর সঙ্গে সম্পর্কেই অবধারিত, একথা কি, অসচেতনেই, মনে হয়েছিল তার? অন্তত গৌরীকে মেনে না নেওয়ায় চারপাশের সমস্ত মানুষজনের সঙ্গেই তার বিরোধের মাত্রা টের পাওয়া যায়।
তাহলে, পাখির সঙ্গেই শুধু সম্পর্ক তৈরি হতে পারে তার? সারির প্রতি একধরনের টান তার আছেই। ছবির শেষের দিকে নটবরের কাছ থেকে সারিকে ছিনিয়ে আনতে চেয়েছিল সে, কিন্তু,যখন সারি বলে যে পাখিরা ‘তোমার আমার মধ্যে ঢুকে পড়েছে। অনেকদিন। তাদের এড়িয়ে আমি তোমার নাগাল পাই না। ঐ লোকটা আমারেই চায়’, আর, ‘লোকটা আমার কোনও অভাব রাখে নাই। এইভাবে যদি সুখ হয়, তবে আমি সুখী’, তখন স্থিরকন্ঠ লক্ষীন্দর : ‘যা তুই, সারি, তুই যা’। সে টের পায়, এই বাদা, এই বিল, আকাশ, পাখি তার আরও কাছের। উলটোদিক থেকে, তারা নিকটতর বলেই সারি বা গৌরীর সঙ্গেও কোনও বন্ধন হবে না তার।
পুরো ছবিতেই তার তন্ময় অকপটতা তাকে কবি হিসেবে চিনতে বাধ্য করে। সে কখনো নম্র, ক্কচিৎ কঠোরও। কিন্তু শমিত অন্তরঙ্গতাই তার স্বভাবের আসল লক্ষণ। পাখিকে দু-আঙুলে বসিয়ে তার সবিস্ময় আদরে চেয়ে থাকা, পাখি উড়িয়ে দেবার আহ্লাদ, ‘কি সোন্দর দেইখেছো--এ্যাঁ, এমন করে দেইখছে যেন কিছুটি হয় নাই’--- এমন উচ্চারণবিস্ময়, এসবেই বোঝা যায় তাকে। শুধু পাখি নয়, একটি আসক্ত দৃশ্যে তাকে দেখা যায় বৃষ্টিস্নাত গাছটির শরীর জড়িয়ে আদর করতে। এইসব কিছুর সঙ্গেই সংলগ্ন সে। তার বিপরীতে কয়েকজন মানুষ ছাড়াও আছে নটবরের মোটর সাইকেলের আওয়াজ ( ছবির শেষে বিধ্বস্ত নটবরের পাশে পড়ে থাকে যে-বিকল দ্বিচক্রযান), আকাশজোড়া মেঘ, মেঘের ডাক (সারি চলে গেছে আগেই। দূর দিয়ে চলে যাচ্ছে গৌরীও, আকাশে তখন অনন্ত মেঘগর্জন শোনা যায়, কাট করে পাশের দৃশ্যে দেখা যায় মেঘবিহ্বল আকাশ, নদীর পুরো জলে যার দুর্মর ছায়া), কলকাতার পথ ও দালান। ক্যামেরার ভাষায় যে বুদ্ধদেব দাশগুপ্ত বুনে চলতে পারেন জটিল অথচ শান্ত কবিতাও, ‘চরাচর’ তার শ্রেষ্ঠ উদাহরণ। ছবিতে যেমন, তেমনি চিত্রনাট্যে। ‘চরাচর’-এর চিত্রনাট্য আলাদাভাবে পড়ার মতো। যেমন :
‘দিনের বেলা। বিলের কাছাকাছি কোনো পাখি ধরার জায়গা। বৃষ্টি পড়ছে। বৃষ্টি খুব জোরে পড়ছে। বৃষ্টি পড়ছে বিলের জলে। সবুজ ঘাসে। আগাছে ভরা মাটিতে’। বোঝাই যাচ্ছে, বৃষ্টির সর্বাঙ্গীণ উচ্ছ্বাস বোঝাতেই তিনবার বৃষ্টির মূর্ছনা। লক্ষীন্দরকে গৌরীর সেই অসম্পূর্ণ প্রস্তাবের পরে :
‘সবটা আর বলতে পারে না গৌরী। সে ছুটে চলে যায়। (তার মুখ একই সঙ্গে প্রণয়ে ও লজ্জায় অপরূপ)।
আবেগে তার কন্ঠে একটা কান্নার শব্দ ফুটে ওঠে’।
তাছাড়াও, ‘খাঁচাগুলির ওপর দিয়ে কলকাতার ভগ্নাংশ আকাশ দেখা যাচ্ছে’, ‘গৌরী পেছন থেকে ডাকে’ : লখাদা! বাড়ি চলো; সর্বনাশ হয়ে গেছে। তার নির্জনতা-ভাঙা কন্ঠস্বরে পাখিগুলো উড়ে যায়’—এরকম আরও অনেক উদ্ধার করা যায়।
বুদ্ধদেবের ‘লাল দরজা’র বিষয়, এই নষ্ট সময়ের উলটো শুদ্ধতায় ফিরতে চাওয়া। ‘চরাচর’-এর মতোই এখানে আছে এমন এক চরিত্র, সারল্য যার রক্তে, ক্ষতশতাব্দীর কোনও প্ররোচনাই যাকে ছুঁতে পারেনি। এই ছবিটিও ‘নিম অন্নপূর্ণা’-‘তাহাদের কথা’র সরণিতেই পড়বে। চারপাশের হিংস্র নোংরামির মধ্যেও পার-হয়ে-আসা অম্লান ছোটোবেলার দিকে অকাতরে ঝুঁকে থাকে এই ছবির বিধ্বস্ত নায়ক। ‘চরাচর’-এ লক্ষীন্দরের স্মৃতি হয়ে যাওয়া শিশুর আবহই যেন ঘনিয়ে ওঠে এই ছবিতেও, নিস্পলক লাল আর উচ্ছ্রিত সবুজে ঝকঝকে শৈশব মুহূর্তে। বিপরীতে সেই প্রাপ্তবয়স্ক, একবাটি শান্ত জল উৎপাটিত দাঁত ফেলে রক্তাক্ত করে দেওয়াই যার জীবিকা।
বুদ্ধদেব দাশগুপ্তর সব ছবিতেই থাকে এমন উত্তীর্ণ দ্বন্দ্বের প্রস্তুতি; এই ব্যাহত চরাচরেই, আবার, উৎকুসুমগুলি ফোটানর তাগিদ।