বাঙালি জীবনে সুফি (তৃতীয় পর্ব) গৌতম রায়

যে সমস্ত সুফী সন্তেরা খলওয়া স্তরে পৌঁছে যান, তাঁদের ভিতরে নির্জন বাসের প্রবণতা খুব বেড়ে যায়। এই স্তররের সুফী সন্তদের ভিতরে অনেকে উজলা ও বলে থাকেন। উজলা স্তরে উপনীত হওয়ার পর সাধকেরা জাগতিক ভালো মন্দ , কোনো কিছুর সঙ্গেই নিজেদের আর সম্পৃক্ত রাখেন না।আধ্যাত্মিকতার একটা সুউচ্চ স্তরে বিরাজৃর অনুভূতি এই খলওয়ার ভিতরে পাওয়া যায় বলে সুফী সন্তদের নিজস্ব অনুভূতি জনিত অনুভব।
তকওয়া স্তর সুফি সাধনার একটি বড়ো পর্যায়। সৃষ্টিকর্তা মহান আল্লাহের প্রতি নির্ভরতার এই স্তর সুফি সন্তদের ভিতরে একটা নিজস্ব আঙ্গিক রচনা করে।আল্লাহের প্রতি প্রেমের , আনুগত্যের, ভালোবাসার , একান্ত নির্ভরতার এই তকওয়া আঙ্গিক সুফি তরিকার সামগ্রিকতাকে প্রেমের বাঁধনের স্থিতিশীল অবস্থানে প্রতিষ্ঠিত করবার ক্ষেত্রে একটা বড়ো ভূমিকা নিয়ে আসছে প্রবাহমান কাল ধরে।
পেশা থেকে নিরাসক্ত ভাব অর্জনের যে ধারা তাকে সুফি সাধকেরা বলেন, ওয়ারা।পেশার সঙ্গে সংযোগ আধ্যাত্মিক জীবনকে বিক্ষিপ্ত করে দেয়।পেশার তাগিদ সৃষ্টিকর্তার প্রতি আকর্ষণ থেকে মন সরিয়ে তাকে সংযুক্ত করে দেয় বস্তুবাদী জগতের সাথে।এই সংযোগ একজন সাধকের আধ্যাত্মিক জীবনকে লাভ ক্ষতির নিগড়ে বেঁধে ফেলে।ফলে সৃষ্টিকর্তার প্রতি আকর্ষণ থেকে মানুষের মনকে নামিয়ে এনে, সেই মনকে আবদ্ধ করে ফেলে বস্তু জগতের দেনা পাওনা, লাভ ক্ষতির ভিতরে।তাই পেশাজীবন কে এই ওয়ারার চর্চার ভিতর দিয়ে সুফি সাধকেরা অত্যন্ত অপ্রয়োজনীয় একটি চর্চা হিসেবে নিজের যাপনচিত্রের মাত্রা নির্ধারণের ক্ষেত্রে নিয়োজিত করেন।
একজন বিশ্বাসী মানুষ যে ধরণের সুখ ভোগের আইনী অধিকার সামাজিক প্রক্রিয়া থেকে এবং অবশ্য ই তাঁর নিজের পারিবারিক অর্জন থেকে লাভ করেন, সেই সুখ ভোগ থেকে বিরত থাকার শিক্ষা সুফি সাধনার একটি বিশেষ গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।দেহ সুখের কোনো আঙ্গিককেই সুফি সাধনায় সমর্থন করা হয় না।পরিবারগত অর্জন থেকে সম্পত্তি জনিত সুখ ভোগ থেকে বিরত থাকার সুফি তরিকার সাধনধারার এই আঙ্গিককে বলা হয় জোহদ।এই ধারাটি একজন সুফি সাধকের জীবনধারণের ক্ষেত্রে অত্যন্ত জরুরি।কোনো রকম জাগতিক ভোগবিলাসের আবর্তের ভিতরে থেকে যে আধ্যাত্মিক জীবন যাপন করতে পারা যায় না- এটি সুফি সাধনার সব কটি আঙ্গিকেই অত্যন্ত জোরের সঙ্গে বলা হয়েছে।
নীরবতার ভাষাকে বাঙ্ময় করে তোলা সুফি সাধনার অবশ্য পালনীয় একটি অভ্যাস। সুফি তরিকায় নীরবতার ভিতর দিয়ে আধ্যাত্মিক পথে এগিয়ে যাওয়ার এই ছন্দোময় অভিধারাকে অভিহিত করা হয় ' সমত' হিসেবে।বাক সংযমের ভিতর দিয়ে জীবন সম্পর্কে শিক্ষা গ্রহণ, সেই উজ্জীবনের ভিতর থাকে যাপনচিত্রের সমুন্নত ধারার সুগভীর অনুশীলন- এই অভ্যাসের ভিতর দিয়ে নিজেকে পরিচালিত করে সাধনার এক সমুন্নত ধারাতে নিজেকে প্রতিষ্ঠিত করা- এটাই হল সমত এর সমুন্নত প্রকাশ।আত্মপ্রকাশ কে এক গভীর নির্জন শান্ত উপলব্ধির ভিতর দিয়ে ফুটিয়ে তোলার অসামান্য দক্ষতা সুফি সাধনার দৈনন্দিন চর্চার একটি গুরুত্বপূর্ণ অঙ্গ।তাই সুফি সাধক বা সুফি ভাবধারাতে আমরা প্রগলভতা - এই বিষয়টি দেখি না।এক শান্ত সমাহিত ভাবধারাতে আধ্যাত্মিক চেতনাকে এভাবেই প্রতিভাত করে তোলেন সুফি সাধকেরা।
সমস্ত রকমের ভয়কে জয় করা হল সুফি সাধনার একটি বিশেষ ঊল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য।এই বৈশিষ্ট্যের আঙ্গিকেই প্রচলিত ধর্মবিশ্বাস, ধর্মবোধের যাবতীয় প্রাতিষ্ঠানিক চিন্তা চেতনার থেকে একটা অনন্যসাধারণ পার্থক্য রয়েছে সুফি ভাবধারার।ইন্দ্রিয় পাছে কোনো অপরাধ করে ফেলতে পারে , তাই ইন্দ্রিয় নিয়ন্ত্রণের হাজার রকম তরিকা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মে আছে। ইন্দ্রিয় ভুল কাজ করতে পারে- এই ধারণার বশবর্তী হয়ে একটা ভয়ের সংস্কৃতি কায়েমের ধারা প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মগুলির চলার পথের বৈশিষ্ট্য।এ ধরণের অনাবশ্যক ভয় কে কোনো অবস্থাতেই এতোটুকু আমল দেন না সুফি সাধকেরা।তাঁরা তাঁদের অনুগামীদের ও এই অনিয়ন্ত্রিত ইন্দ্রিয় জনিত ভয়ের সাম্রাজ্যের বাসিন্দা না হওয়ার ই পরামর্শ সব সময়ে দিয়ে থাকেন। সুফি সাধনার এই অভিধারা টিকে চিহ্নিত করা হয় খউফ হিশেবে। সুফি সাধনাতে যে দ্বিধাহীন চিত্তে প্রেমের জয়গানের কথা বলা হয়েছে, সেই চেতনার বিকাশে ' খউফ ' খুব ই কার্যকরী একটি অধ্যায়।এই ভাবে ভয়কে জয় করবার জন্যে উদ্বুদ্ধ করতে প্রাতিষ্ঠানিক ধারার ধর্মীয় তরিকাগুলিকে কখনোই কিন্তু আমরা দেখি না।
ভবিষৎতের ইচ্ছে কে পরিপূর্ণ করবার দিকে প্রাতিষ্ঠানিক ধর্মের পরম্পরা টা এই সুফি ভাবধারার ভিতরে বেশ শক্তিশালী। একধরণের আশাবাদ সুফি সাধনাতে প্রোজ্জ্বল হয়ে উঠতে দেখা যায়। এই আশাকে কিন্তু ধর্মের সাম্রাজ্য বিস্তারের নাম করে শাসনযন্ত্র কে করায়ত্ত করবার লক্ষ্যে কখনোই পরিচালিত হয় না সুফি ভাবধারার ভিতরে। প্রাতিষ্ঠানিক ধর্ম তার সাধনার ফল কে বস্তুর নিরিখে বিচার করে।সেই বিচারে বেশিরভাগ সময়েই প্রকট হয়ে ওঠে ক্ষমতার অলিন্দ্যে প্রবেশের উদগ্র বাসনা। সেই বাসনাই ক্রমে ধর্মের হাত কে একধরণের লোলুপ দৃষ্টিতে প্রসারিত করে রাষ্ট্রক্ষমতার দিকে। সুফি মতবাদ কিন্তু সাধনার ধারাকে কখনোই কোনো অভিলাষের দিকে পরিচালিত করে না। সুফি সাধকের আধ্যাত্মিকতার এই বৈশিষ্ট্য অভিহিত করা হয় ' বরা' হিসেবে।
সুফি সাধনায় অতীতের কর্মকান্ডের জন্যে অনুতপ্ত হয়ে সেখান থেকে শিক্ষা নেওয়ার উপর বিশেষ গুরুত্ব আরোপ করা হয়।সাধক জীবন যাপন করলেই অতীতে সে কখনো ভুল করে নি, অন্যায় করে নি- এমন সরলীকৃত ধারণার উপরে সুফি সাধনাতে কখনোই গুরুত্ব দেওয়া হয় না।রক্তমাংসের মানুষ , সে অতীতে ভুল করতেই পারে, অন্যায় করতেই পারে, মানুষের প্রতি অবিচার করতেই পারে।সাধকজীবনে সেই অন্যায়ের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, অবিচারের পুনরাবৃত্তি যাতে না হয়, সেদিকে তীক্ষ্ণ নজর দেওয়ার উপরে সুফি সাধনাতে যে বিশেষ গুরুত্ব প্রদান করা হয়েছে, তাকে বলা হয়, হুযন।এই হুযন, অর্থাৎ ; কৃত অন্যায়ের প্রতি অনুতপ্ত হয়ে , সেই অন্যায় থেকে শিক্ষা গ্রহণ করে সাধক জীবনকে পরিচালনা করা, ভাবধারার মানুষদের ও সেই পথে হাঁটতে উদ্বুদ্ধ করা- এটা সুফি সাধনার অত্যন্ত উল্লেখযোগ্য বৈশিষ্ট্য । ( চলবে)