অনেকেই বলেন নামে কি আসে যায়। গোলাপকে যে নামেই ডাকো; গোলাপ সব সময়েই সুন্দর থাকে। জ্যোতিষ মতে মানুষের নামকরণ কিন্তু হেলাফেলার বিষয় নয়। একটি নামের সদর্থক কম্পন মানুষের জীবনে সদর্থক প্রভাব নিয়ে আসে এবং সৌভাগ্য ও ব্যক্তিত্বের প্রকাশ ঘটায়। নাম শুধু ব্যক্তি মানুষের পরিচয় বহন করে না, প্রত্যেক মানুষের সৌভাগ্য ও স্বতন্ত্র পরিচিতির জন্য সু-নামকরণ অতি আবশ্যক।
ভারতীয় সমাজ-সংস্কৃতিতে নামকরণ একটি উল্লেখযোগ্য সংস্কার এবং দশবিধ সংস্কারের অন্যতম। বর্তমানে সংস্কারটি শিশুর জন্মের একমাসের মধ্যে অথবা অন্নপ্রাশনের আগে সম্পন্ন করা হয়। পরিবারে নবজাতক ভূমিষ্ঠ হওয়ার পর সন্তানের ঠিকুজী (সংক্ষিপ্ত কোষ্ঠী) প্রস্তুত করা হয়। রাশিচক্র দেখে জন্মরাশি নির্দেশিত আদ্যাক্ষর অনুসারে নামকরণ করা হয়। বিবাহ ও উপনয়নের মতোই নামকরণ সংস্কার সারা ভারতে বহুল প্রচলিত ও জনপ্রিয়। ভারতের বিভিন্ন অঞ্চলে নামকরণ নিয়ে সামান্য কিছু পার্থক্য থাকলেও সন্তানের নামকরণের ক্ষেত্রে একটা সাধারণ বিধি সকলেই মেনে চলেন। সেটা হল, প্রথমে জাতকের নাম, তারপর পদ-পূরক মধ্য-নাম ও শেষে জাতকের পদবি বা উপাধি। এছাড়া ভারতের কয়েকটি অঞ্চলে জাতকের নামের সঙ্গে পিতার নাম (গুজরাত/মহারাষ্ট্র)
জুড়ে দিয়ে থাকেন। দক্ষিণ ভারতে জাতকের নামের সঙ্গে জন্মস্থানের নাম এবং ক্ষেত্র বিশেষে পরিবারের উপাস্য দেবদেবী বা কুলদেবতার নাম জুড়ে দেওয়া হয়। এই ধরনের নামকরণ অনেক সময় এতো বড় হয়ে যায় যে, তা সংক্ষেপে না লিখে উপায় থাকেনা। যেমন – A. P. J. ABDUL KALAM, E. M. S. NAMBRUDIPAD, অন্যগুলির উদাহরণ হল-শচীন রমেশ তেন্ডুলকর, মোহন দাস করমচাঁদ গান্ধি। দক্ষিণ ভারতে আগে স্থান নাম ও সবশেষে উপাস্যের নাম লেখা হয়। উদাহরণ - বেঙ্গালোর ভেঙ্কট রমণ। প্রথমটি জন্মস্থানের নাম, মাঝেরটি পরিবারের উপাস্য কুলদেবতা ভেঙ্কটেশ/শিব, শেষেরটি পদবী।
নামকরণের ক্ষেত্রে আমরা বাংলা ও সমগ্র পূর্বাঞ্চলে বহুল প্রচলিত নামকরণ পদ্ধতিটি নিয়ে আলোচনা করবো। এক্ষেত্রে রাশি নির্দেশিত আদ্যাক্ষর অনুসারে নামকরণ ও প্রয়োজনে সংখ্যাতত্ব অনুসারে নাম সংশোধন করব। এছাড়া, নামকরণের সময় জাতক/জাতিকা-র পারিবারিক ঐতিহ্যের সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ নামকরণের ধারাটিকে সর্বদা অগ্রাধিকার দেব।
কীভাবে সঠিক নামকরণ করবেন
১) নামকরণের সময় প্রথমেই জাতকের রাশি নির্ণয় করে নামের আদ্যাক্ষর নির্ণয় করতে হবে। আদ্যাক্ষরগুলির সঙ্গে কোন অক্ষরটি পরিবারের ঐতিহ্য ও অন্য সদস্যদের নামের সঙ্গে সামঞ্জস্য পূর্ণ কিনা দেখে নিতে হবে।
২) নাম নির্বাচনের সময় লক্ষ্য রাখতে হবে নামটি যেন – সংক্ষিপ্ত, শ্রুতিমধুর, সদর্থক অর্থপূর্ণ, সহজ, সরল বানান যুক্ত এবং সংখ্যাতাত্ত্বিক ভাবে শুভ হয়। এছাড়া খেয়াল রাখতে হবে নাম সংখ্যাটি যেন ভাগ্য সংখ্যার থেকে বড় বা সমান হয়
৩) ছোটবেলা থেকে একটাই নাম ব্যবহার করুন এবং একাধিক নাম বর্জন করুন। পরিবারের নানাজনের আদর করা নানা রকম নামকরণ বিভ্রান্তি বাড়িয়ে তোলে বই কমায় না। তাই ভেবে চিন্তে নাম ঠিক করুন এবং ছোটবেলা থেকে একটাই নাম ব্যবহার করুন। মনে রাখবেন, নাম-ই একমাত্র জিনিষ যা জাতকের নিজের অথচ ব্যবহার করেন জাতক ছাড়া দুনিয়ার সকল মানুষ। নাম শুধু শনাক্তকরণ বা পরিচিতির জন্য নয়, নাম জাতকের সেলফ ইমেজও বটে।
৪) সর্ব ভারতীয় সমস্ত সরকারি কাজকর্মে যেহেতু ইংরাজি ভাষা ব্যবহৃত হয়ে থাকে সে কারণে বাংলা নামের পাশাপাশি সঠিক ও সুনির্দিষ্ট ইংরাজি বানান ঠিক করে নিতে হবে। বিশেষ করে সন্তানের জন্ম প্রমাণপত্র গ্রহণ করার সময় যথাযথ বানান বজায় রেখে কাগজপত্র করিয়ে নিতে হবে। অন্যথায় ভবিষ্যতে দরকারি কাগজ পত্রে নাম বিভ্রাটের জন্য ঝামেলায় পড়তে হবে। যে কোনও কাজে নাম নথিভুক্ত করার সময় অবশ্যই খেয়াল রাখবেন- নামটি যেন যথাযথ ভাবে নথিভুক্ত হয়। বিশেষ করে - বার্থ সার্টিফিকেট, রেশন কার্ড, স্কুল-কলেজে ভর্তি হওয়া বা শিক্ষার প্রমাণপত্র, চিকিৎসার জন্য হসপিটাল বা নার্সিং হোমে ভর্তি করা, ড্রাইভিং লাইসেন্স, আধার কার্ড, পাসপোর্ট, প্যান কার্ড, ব্যাংকের খাতা, জীবন বীমা ও স্বাস্থ্য বীমা, যে কোনও দলিল, চুক্তিপত্র, দানপত্র ইত্যাদি কাগজপত্রে যেন সঠিক বানান সহ নামটি নথিভুক্ত হয়।
৫) সকলেই নিত্য-নতুন ও বৈচিত্র্যময় নাম খোঁজেন। যুতসই নতুন নাম খোঁজার গোলকধাঁধায় পড়ে অনেকই ভুলে ভরা ও চটকদার কিছু শব্দে সন্তানের নামকরণ করেন। যারা নিত্য-নতুন নাম খোঁজেন তাদের বলি হাতের কাছেই আছে তার সহজ সমাধান। বাংলা ভাষা ও সাহিত্য অফুরান শব্দের ভাণ্ডার। একটু খুঁজলেই পাবেন অজস্র নামের ফল্গুধারা। আর, আপনার মগজাস্ত্রকে যদি একটুও ঘামাতে না চান তাহলে খুলে দেখুন শ্রী জাত-র লেখা “নামকরণ অভিধান” অথবা অন্য যে কোনও লেখকের নামকরণ অভিধান । অচেনা ও অজানা বাংলা নামের বিপুল ভাণ্ডার দেখে নিজেই অবাক হয়ে যাবেন।
৬) যাদের রাশিচক্র নেই। শুধুমাত্র জন্ম মাস জানা আছে, তারা জন্মমাস (সান সাইন) অনুসারে নামকরণ করবেন। রাশি অনুসারে নামের আদ্যাক্ষর দেখে (চার্ট-১ দেখুন) ।
আপনার সন্তানের জন্য প্রিয় নামটি কিভাবে নির্বাচন করুন
৭) নামকরণ করা সহজ হলেও নাম সংশোধন করার কাজটা খুব একটা সহজ নয়। নাম সংশোধনের একাধিক প্রক্রিয়া ও পদ্ধতি আছে। নাম সংশোধন করতে হলে যথেষ্ট অভিজ্ঞতা ও দক্ষতা থাকা আবশ্যক। একান্তই যদি নাম সংশোধন করতে হয়, তাহলে কোনও অভিজ্ঞ ও শাস্ত্রজ্ঞ জ্যোতিষীর পরামর্শ নিন।

সঠিক নামকরণের উদাহরণ
সাধারণ ভাবে রাশিগত নাম এবং পারিবারিক নামকরণ ধারার মধ্যে বেশির ভাগ ক্ষেত্রেই মিল পাওয়া যায় না। সেক্ষেত্রে পারিবারিক নামকরণের ধারাটিকে বজায় রেখে নামকরণ করতে হবে। যেমন ধরুন- প্রখ্যাত জাদুকর পি সি সরকার (Sr.) তিন পুত্রের নাম নিজের নামের আদ্যাক্ষর অনুসারে রেখেছিলেন, যাতে তাঁর পরবর্তী প্রজন্ম তাঁর জাদু ঐতিহ্য কে ধরে রাখতে পারে এবং আরও এগিয়ে নিয়ে যেতে পারে। এছাড়া অনেকেই রাশিগত নামকরণের ঝুট ঝামেলায় যেতে চান না অথচ সন্তানের জন্য সুন্দর ও আধুনিক নাম রাখতে চান। সন্তানের নামকরণ নিজেরাই ঠিক করে নেন। সেকারণে নামকরণের কয়েকটি উদাহরণ তুলে ধরলাম যাতে সাধারণ জ্যোতিষ বিশ্বাসী মানুষ নিজেরাই সন্তানের নামকরণ করে নিতে পারেন এবং প্রয়োজনে শাস্ত্রজ্ঞ জ্যোতিষীর পরামর্শ নিতে পারেন।
১) নামকরণের সময় “S4“ কথাটি মনে রাখবেন অর্থাৎ নামটি যেন – Sweet Sounded, Short, Similarity (Name & Surname), Simple Spelling - যুক্ত হয় এবং সংখ্যাতাত্ত্বিক ভাবে যতটা সম্ভব শুভ হয় (উদাহরণ -১ দেখুন)।
২) নাম ও জন্মতারিখের সাম্য বজায় রেখে সংখ্যাতাত্ত্বিক ভাবে নামকরণ করা –
যেমন ধরুন কোনও এক ভদ্রলোকের জন্মতারিখ - 04 - 07 – 1970, নাম - শ্রী অশোক চক্রবর্তী, ইংরাজি বানানে লেখেন - ASOKE CHAKRABORTY, ওনার জন্ম সংখ্যা = 4 , নামের আদ্যাক্ষর = 1 ভাগ্য সংখ্যা = 1, নাম সংখ্যা = 2, ভাগ্য সংখ্যার থেকে নাম সংখ্যা বড় হওয়ায় শুভত্ত্ব বেশী, সংখ্যা চক্রের প্রথম চক্রের সঙ্গে মিল বেশী অর্থাৎ মেটিরিয়াল হুইলের সংখ্যা 1,4,7 -এর প্রাধান্য বেশী। ফলে নামকরণে সার্বিক সাম্য আছে এবং 70% শুভত্ব পাওয়া যাচ্ছে। নামটি সংশোধন করে যদি - ASOKE এর বদলে ASHOKE লেখা হয় তাহলে নামের শুভত্ব বেড়ে যাবে এবং নামটি সমস্ত দিক থেকে শুভ কারক (100%) হয়ে উঠবে।
উদাহরণ – ২
নাম সংশোধনের আগে =
A S H O K E C H A K R A B O R T Y
1 1 6 2 5 3 8 1 2 9 1 2 6 9 2 7
15 50
6 + 5 = 11 = 1+ 1 = 2
নাম সংশোধনের পরে =
A S H O K E C H A K R A B O R T Y
1 1 8 6 2 5 3 8 1 2 9 1 2 6 9 2 7
23 = 5 50 = 5
5 + 5 = 10 = 1
পরিশেষে জানাই সঠিক নামকরণ জীবনে খুবই গুরুত্বপূর্ণ বিষয় অথচ নামকরণের ব্যাপারে সাধারণ মানুষ খুব একটা ওয়াকিবহাল বা সচেতন নয়। জন্ম তারিখ পরিবর্তন করা যায় না, কিন্তু সঠিক নাম নির্বাচন করে এবং সংখ্যাতত্ত্ব অনুসারে বানান পরিবর্তন করে, নাম ও সংখ্যার সামঞ্জস্য অনায়াসেই বজায় রাখা যায়। মনে রাখবেন, নাম ও সংখ্যার সাম্য - জীবনে গড়ে তোলে ভাগ্য ও কর্মের ভারসাম্য ।
