সুপ্রাচীন কাল থেকেই ভারতবর্ষ ধর্ম, দর্শন ও অধ্যাত্মবাদের সূতিকাগৃহ, শত শত সাধক-সাধিকা ভারতের মাটিতে অবতীর্ণ হয়েছেন। বিশ্বের দরবারে ছড়িয়ে দিয়েছেন সনাতন ধর্মের শাশ্বত বাণী “মরো না, মেরো না, পারত মৃত্যুকে অবলুপ্ত করো”।
ক্ষণজন্মা এই সব সাধক প্রবরদের জীবন আলেখ্য মহা-বিস্ময়কর। হাজার হাজার মানুষ যখন স্নেহ-মায়া-মমতায় ভরা জগত সংসারের মায়ায় আষ্টেপৃষ্ঠে জড়িয়ে পড়ে, তখন এই মানুষগুলো কত অনায়াসে রাজকীয় ভোগবিলাস, সুখ-স্বাচ্ছন্দ্য ও ঐশ্বর্য ত্যাগ করে, মায়ের বুক ফাটা কান্না উপেক্ষা করে, এমন কি স্ত্রীর চোখের জল অথবা শিশু সন্তানের হাসিমুখের হাতছানি ভুলে- নির্দ্বিধায় সাধন মার্গের পথে পা বাড়ান-সর্বত্যাগী সন্ন্যাসী হন, কোন পরম সত্য লাভের জন্য। কিসের টানে? এই সব জিজ্ঞাসার উত্তর পাওয়া যায় সনাতন জ্যোতিষে। সেকারণে প্রাচীনকালের শ্রীকৃষ্ণ, গৌতম বুদ্ধ, শ্রী চৈতন্য থেকে শুরু করে আধুনিক কালের শ্রীল প্রভুপাদ (ইস্কন), সত্য সাঁই বাবা, রজনীশ এবং বর্তমান “Art of Living” প্রবক্তা শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর-জী পর্যন্ত শতাধিক রাশিচক্র অনুসন্ধিৎসু মন নিয়ে বিচার ও পর্যালোচনা করেছি। সমগ্র আলোচনাটি সনাতন জ্যোতিষের আলোয় স্বল্প পরিসরে তুলে ধরলাম। রাশিচক্রগুলো যুগ অনুসারে দেওয়া আছে।
মানুষ কখন সাধনার পথে অগ্রসর হয়
সনাতন ধর্ম, দর্শন ও জ্যোতিষ অনুসারে মোক্ষ লাভই জীবনের একমাত্র মূল উদ্দেশ্য। জন্মজন্মান্তরের সঞ্চিত কর্মফল অবিনাশী আত্মার মাধ্যমে এক জীবন থেকে আরেক জীবনে প্রবাহিত হয়, চলমান সেই জীবন প্রবাহে আত্মা (জীবাত্মা) যখন পরিপূর্ণ শুদ্ধসত্ত্ব লাভ করে, তখনই আধ্যাত্মিক চেতনার উন্মেষ হয়, জাগতিক সমস্ত “মায়া-মোহ-বন্ধন” স্বপ্নবৎ ত্যাগ করে মানুষ ঈশ্বর মুখী হয়, সাধনার পথে পা বাড়ায়। ঈশ্বর লাভ হলে মানব আত্মা পরমাত্মায় লীন হয়ে যায়। পুনর্জন্ম হয় না। তাই দুর্লভ মানব জীবনে মোক্ষলাভই মহা-মুক্তির একমাত্র পথ। ঈশ্বর লাভ হলে সমস্ত চাওয়া-পাওয়ার সমাপ্তি ঘটে।












আধ্যাত্মিকতার জ্যোতিষ সূত্র: ও অন্যান্য উপাদান
ক) কারক গ্রহঃ
শনি, কেতু ও বৃহস্পতি (প্রধান)
রবি ও চন্দ্র (অপ্রধান)
শনি - ত্যাগ, সন্ন্যাস, বৈরাগ্য ও প্রব্রজ্যা।
বৃহস্পতি – ধর্ম, গুরু, জ্ঞান ও অন্তর্দৃষ্টি
কেতু – মোক্ষ, মুক্তি, সমাধি, গুপ্তজ্ঞান
খ) প্রধান ভাব- নবম ভাব (ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতা)
সহযোগী ভাব – পঞ্চম, দশম, একাদশ ও দ্বাদশ।
পঞ্চম- মন্ত্র, দীক্ষা ও পূজার্চনা
নবম – ধর্ম, সন্ন্যাস, প্রব্রজ্যা
দশম – সাধনা / তপস্যা
একাদশ – সিদ্ধি লাভ
দ্বাদশ – মোক্ষ ও মহা মুক্তি।
গ) আধ্যাত্মিকতার শুভ যোগঃ
সন্ন্যাস ও প্রব্রজ্যা যোগ, শশ যোগ, হংস যোগ, গজ কেশরী যোগ, গুরু সৌরি যোগ, প্রবল দারিদ্র যোগ, ‘শনি+চন্দ্র’ যোগ (নৈরাশ্য ও বিষাদ কারক),
ঘ) ভাব কেন্দ্রিক অন্যান্য যোগঃ
১) বক্রী শনি নবম পতি হয়ে স্বক্ষেত্রে, তুঙ্গ ক্ষেত্রে বা মূল ত্রিকোণে অবস্থান করলে।
২) শনি নবমে বা দশমে কিন্তু কোনও গ্রহ দ্বারা দৃষ্ট না হলে।
৩) শনি বা বৃহস্পতি নবমে এবং দ্বাদশে কেতু অবস্থান করলে।
৪) লগ্ন, চন্দ্র ও বৃহস্পতি শনি দ্বারা দৃষ্ট এবং বলবান শুভ বৃহস্পতি লগ্নে অবস্থান করলে।
৫) যে কোনও রাশিতে চার বা ততোধিক গ্রহ একত্রে থাকলে।
৬) লগ্নের যোগকারক গ্রহ নবমে অবস্থিত হয়ে বৃহঃ ও শনি দ্বারা দৃষ্ট এবং দ্বাদশে কেতু অবস্থান করলে।
৭) লগ্নে, কেন্দ্রে, কোণে তিন বা ততোধিক গ্রহ তুঙ্গস্থ হলে।
৮) নবমে চন্দ্র কিন্তু কোনও শুভ গ্রহ দ্বারা দৃষ্ট না হলে।
৯) প্রবল দারিদ্র যোগের সঙ্গে যদি পঞ্চম ও নবম ভাব বা ভাব পতি শুভ হলে।
দীক্ষা ও সন্ন্যাস কখন হবে:
পঞ্চম ও নবম পতির শুভ দশা-অন্তর্দশায় অথবা যোগকারক গ্রহ যখন গোচরে পঞ্চম বা নবম ভাবে অবস্থান করবে।
গুরু ও সাধনার ধারা কেমন হবে:
পঞ্চম ও নবম ভাব পতি এবং যোগকারক গ্রহের অবস্থান, যোগজ বলাবলের তারতম্য অনুসারে দীক্ষাগুরু ও সাধনার ধারা নির্দিষ্ট হয়। গ্রহের শুভাশুভ প্রভাব ও চরিত্র ধর্ম অনুসারে দীক্ষাগুরু সাত্ত্বিক-তামসিক বা রাজসিক হবে। একই ভাবে সাধনার ধারা - শাক্ত, শৈব, গাণপত্য, বৈষ্ণব ও প্রাজাপত্য হয়ে থাকে।
সন্ন্যাস যোগ কখন ভঙ্গ হয় –
সন্ন্যাস যোগ ভঙ্গ হবে যদি- ১) যোগকারক গ্রহ রাহু যুক্ত হয়, পাপ নবাংশ গত হয়, গুলিক বা মান্দি যুক্ত হয়।
২) যোগকারক গ্রহ অস্তমিত (Combust) হয়, নীচস্থ বা শত্রু ক্ষেত্র গত হয়।
৩) লগ্ন পতি ও চন্দ্র যদি নীচস্থ বা অন্য কোনও ভাবে দুর্বল হয়।
রবি ও চন্দ্রের বিশেষ ভূমিকা
সন্ন্যাস ও আধ্যাত্মিকতার ক্ষেত্রে রবি ও চন্দ্রের অবস্থান বিশেষ তাৎপর্যপূর্ণ, সমস্ত সাধক-সাধিকাদের রাশিচক্রে রবি ও চন্দ্রের অবস্থান, জন্ম গ্রহণকাল, মাতৃ যোনি ধারণ এবং গর্ভজাত হওয়ার কালে দৈব প্রত্যাদেশ, স্বপ্নদর্শন বা বিশেষ অনুভূতির ঘটনা যুক্ত থাকে। এক্ষেত্রে সাধক-সাধিকার বাবা-মা বিশেষ গুণ সম্পন্ন হয়। যেমন- তারা সকলেই ঈশ্বর অনুরাগী, সাত্ত্বিক জীবন ধারা এবং সন্তান একনিষ্ঠ। এক্ষেত্রে রবি ও চন্দ্র সাধকের মাতা ও পিতা কারক। রবি-পিতা, দেহ ও বীজ, চন্দ্র- মাতা, মন ও ক্ষেত্র, রাশিচক্র রবি, চন্দ্রের পক্ষবল, পূর্ণিমা বা পূর্ণিমার চন্দ্রের নক্ষত্রে, নবম ভাব ও কেতুকে শনি, বৃহস্পতি, মঙ্গল ও শুক্র পূর্ণ দৃষ্টি দিচ্ছে। এছাড়া স্বক্ষেত্রস্থ রবি ও বুধ এবং পঞ্চমে বুধ ও বৃহস্পতির সহাবস্থান বিশেষ শুভ যোগ।
ভগবান গৌতম বুদ্ধের জন্ম বৈশাখী পূর্ণিমায়, দশমে পাঁচটি গ্রহ রয়েছে। শনি ও চন্দ্র সম সপ্তমে, শনি-চন্দ্র যোগ বর্তমান। রাশি, লগ্ন ও দশম ভাব তিনটেই চর রাশি, দশমে পঞ্চ গ্রহ যোগ, যোগকারক মঙ্গল, স্বক্ষেত্রে রবি তুঙ্গস্থ, নবম, দশম ও একাদশ পতির সহাবস্থান। সর্বোপরি দ্বাদশে মোক্ষ স্থানে শনির দৃষ্টি থাকায় সন্ন্যাস ও মহা মুক্তির যোগ দৃষ্ট। একই ভাবে শ্রীচৈতন্যের রাশিচক্রে দৃষ্টি বশত রবি-চন্দ্র, শনি-চন্দ্র যোগ, দ্বাদশে নবম পতি বুধের দৃষ্টি এবং একাদশে চন্দ্রের ওপর রবি, শনি, বৃহস্পতি ও মঙ্গলের দৃষ্টি রয়েছে।
রামকৃষ্ণ দেবের কুম্ভ রাশি ও কুম্ভ লগ্ন। কুম্ভ স্থির ও আধ্যাত্মিক রাশি, শুক্র, মঙ্গল, শনি তিনটে গ্রহ তুঙ্গস্থ। বুধ, বৃহস্পতি ও শনি বক্রী। লগ্নে আধ্যাত্মিক যোগ, নবমে বক্রী শনি তুলা লগ্ন। বৃহস্পতি শনি ও লগ্নকে দেখছে। অন্যদিকে স্বামী বিবেকানন্দের রাশিচক্রে নবম পতি রবি মকরে শনির ক্ষেত্রে বুধ ও শুক্র যুক্ত। মঙ্গল পঞ্চম পতি, বৃহস্পতি দৃষ্ট, দশমে শনি-চন্দ্রের সহাবস্থান। দ্বাদশে মঙ্গল ও শনির দৃষ্টি রয়েছে।
গুরু রজনীশ ও সত্য সাই বাবার রাশিচক্রে চতুর্গ্রহ যোগ বর্তমান, উভয়ের রাশিচক্রে দশমে শনির দৃষ্টি রয়েছে। রজনীশের রাশিচক্রে শনি-চন্দ্র যোগ বর্তমান। ইস্কন প্রতিষ্ঠাতা প্রভুপাদের নবম পতি রবি নবমে, বৃহস্পতি ও কেতু যুক্ত। বৃহস্পতি, শনি লগ্নকে দেখছে। শনি একাদশে তুঙ্গস্থ। সত্য সাই বাবা ও রজনীশের রাশিচক্রে ধর্ম ও আধ্যাত্মিকতার সঙ্গে সেবা ও রাজসিক কর্মকাণ্ডের প্রাধান্য বেশী। অন্যদিকে প্রভুপাদের রাশিচক্রে জ্ঞান, কর্ম ও সাংগঠনিক কর্মধারার মেলবন্ধন লক্ষ্য করার মত।
শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর-জী ও আনন্দময়ী মায়ের রাশিচক্র দুটি বেশ অভিনব। তাদের রাশিচক্রে চারটি গ্রহ শুক্র, রবি, বৃহস্পতি ও শনি তুঙ্গস্থ। রবিশঙ্কর-জীর রাশিচক্রে রবি, বৃহস্পতি ও মঙ্গল তুঙ্গস্থ, তিনটেই চর রাশিতে হওয়ায় বেশী বলবান। উভয়েরই শনি অষ্টমে বক্রী হয়ে অবস্থান করছে। রবিশঙ্কর-জীর রাশিচক্রে নবম পতি তুঙ্গস্থ হয়ে চতুর্থে, অষ্টমস্থ শনিকে, দশমে মঙ্গলকে এবং দ্বাদশে দৃষ্টি দিচ্ছে। অন্যদিকে মায়ের রাশিচক্রে নবম পতি মঙ্গল দ্বাদশে, লগ্ন পতি পঞ্চমে তুঙ্গস্থ, শনি দৃষ্ট। বৃহস্পতি নবমে নীচস্থ চন্দ্রকে ও লগ্নকে দৃষ্টি দিচ্ছে। শ্রী শ্রী আনন্দময়ী মা সুদীর্ঘকাল বহু মানুষের আধ্যাত্মিকতা, ও ধর্মীয় চেতনার প্রেরণাদার্ত্রী ছিলেন। শ্রীশ্রী রবিশঙ্কর-জী বর্তমানে “সুদর্শন ক্রিয়া” ও “Art of Living” নামক ধ্যান-প্রাণায়াম ও যোগ দ্বারা বহু মানুষের আধ্যাত্মিক চেতনার আলোকবর্তিকা স্বরূপ ভাস্বর হয়ে বিরাজ করছেন।
বর্তমান প্রবন্ধের স্বল্প পরিসরে অতি সংক্ষেপে সমগ্র বিষয়টি উপস্থাপন করার চেষ্টা করেছি।আলোচিত বিচার ধারা অনুসারে সবকটি রাশিচক্র বিস্তারিত ভাবে নিজেরাই মিলিয়ে দেখুন। আপনাদের মতামতের সাগ্রহ প্রতীক্ষায় রইলাম। কেমন লাগল জানাবেন।