উত্তরবঙ্গের নব ভাষ্য — কবিতার আঙ্গিকে - অমিত চৌধুরী

    আঞ্চলিক কবিতা পাঠের একটি বড় লাভ হল, কবিতা পাঠের মধ্য দিয়ে সেই অঞ্চলের মানস পরিভ্রমণ সম্ভব হয়। সে ভ্রমণে সেই অঞ্চলের সংস্কৃতি, জীবনযাত্রা আমাদের সমৃদ্ধ ও মুগ্ধ করে। প্রমোদ নাথের সম্পাদনায় ‘এক আকাশ অনেক মানুষ’ কাব্যগ্রন্থটি আমাদের সেই মুগ্ধতায় পরিপূর্ণ করে। সম্পাদক-এর উত্তরবঙ্গ যোগ এই কাব্যগ্রন্থ রূপায়ণে যে বিশেষ তৎপর থেকেছে তা বলাই বাহুল্য। প্রমোদ নাথ উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন জনগোষ্ঠীর সমাজ-সংস্কৃতির আগ্রহী গবেষক। ফলতঃ সেই আগ্রহই যে তাঁকে উক্ত জনগোষ্ঠীর বিভিন্ন কবিতা সংকলনের প্রয়াসী করে তুলেছে তা নিঃসন্দেহে বলাই যায়। তবে এ কাব্যগ্রন্থ শুধুমাত্র উত্তরবঙ্গ-এর বিভিন্ন জনজাতির আঞ্চলিক কবিতার সংকলন নয়, প্রমোদ নাথ তাঁর সম্পাদনার মধ্য দিয়ে সেই কবিতাগুলির বাংলা ভাষান্তর করেছেন যাতে তা সাধারণ বাঙালি পাঠকের রস আস্বাদনে কোন বাধার সৃষ্টি না করে। এখানেই এই উদ্যোগ অভিনব। কারণ আঞ্চলিক কবিতার এই ধরনের ভাষান্তর খুব সহজলভ্য নয়। ফলে দক্ষিণবঙ্গের এক বিপুল পাঠকসমাজ যাঁরা শুধু ভাষার আঞ্চলিকতাকে বুঝতে সক্ষম নন বলে সেই অঞ্চলের কাব্যপাঠ ও রসাস্বাদন থেকে বুঝতে সক্ষম নন বলে সেই অঞ্চলের কাব্যপাঠ ও রসাস্বাদন থেকে বঞ্চিত থাকেন, তাদের কাছে এই উদ্যোগ সাধুবাদযোগ্য।
    সম্পাদক মূলত উত্তরবঙ্গের বিভিন্ন অঞ্চলের আঞ্চলিক কবিদের কবিতা সংগ্রহ ও সংকলন করে তার ভাষান্তর ঘটিয়েছেন। আমাদের সাধারণ্যে একটি খুব প্রচলিত ধারণা রয়েছে যে উত্তরবঙ্গের জনজাতি মঙ্গোলয়েড গোষ্ঠীভুক্ত। কিন্তু সম্পাদক ‘প্রস্তাবনা’ অংশেই আমাদের সেই সংশয়কে দূরীভূত করেন। সেখানে এক দীর্ঘ আলোচনায় তিনি দেখান, উত্তরবঙ্গের জনসমষ্টিতে কালের প্রবাহে দ্রাবিড়, অস্ট্রিক জনগোষ্ঠীর ভাষার সঙ্গে সঙ্গে মিলিত হয়েছে ভারতীয় আর্য ভাষার ভাষাভাষী মানুষও। তাই এই সংকলনে রাভা, মেচ বা বোড়ো ভাষার সাথে হিন্দি বা বাঙাল ভাষার কবিতাও স্থান পেয়েছে। ফলে সংকলকের উদ্দেশ্য সুস্পষ্ট হয়ে ওঠে। তিনি উত্তরবঙ্গের বিশেষ কোন জনজাতির ভাষা নয়, তিনি বর্তমানে উত্তরবঙ্গের প্রচলিত সমস্ত ভাষার আঞ্চলিকতাকে ধরতে চেয়েছেন।
    কবিতা পাঠের শুরুতেই ‘প্রস্তাবনা’ অংশে সম্পাদক যেভাবে উত্তরবঙ্গের নামকরণের ইতিহাসের সঙ্গে সেই অঞ্চলের বিভিন্ন ভাষার সেই ইতিহাস তথ্যপূর্ণ অথচ সহজভাষায় আমাদের সামনে এনেছেন তা নিঃসন্দেহে প্রশংসার দাবী রাখে। মালদা জেলার ‘খুট্টা’ বা ‘খোট্টা’ ভাষা যে মৈথিলি ও বাংলার সংমিশ্রিত তার সঙ্গে উর্দু ও হিন্দির ভাষারূপের প্রভাব রয়েছে — এই তথ্য ভাষা পাঠক বা ভাষা গবেষকের কাছেও আগ্রহের বিষয়। এই প্রসঙ্গেই সম্পাদক নেওয়ারদের কথা বলেছেন। দার্জিলিং-এর তিনটি পার্বত্য মহকুমায় বসবাসকারী এই নেওয়ারদের আগমন যে নেপাল থেকে এবং ভাষাগোষ্ঠীর দিক থেকে এরা যে ভোট-বর্মা ভাষাগোষ্ঠীর অন্তর্ভুক্ত সেই তথ্য আমাদের সমৃদ্ধ করে। তাই শুধু আঞ্চলিক কবিতা নয়, সেই অঞ্চল, সেই আঞ্চলিক ভাষার তথ্য আমাদের সামনে তুলে ধরে কবিতা পাঠের আগ্রহকে ত্বরান্বিত করেছে।
    প্রথমেই কবিতার নিবিড় আলোচনার পূর্বে একথা বলা যেতে পারে যে, এই কবিতাগুলি সম্পাদকের সংকলন ও বাংলা ভাষান্তর। ‘অনুবাদ’ শব্দটিকে রাখার ক্ষেত্রে আমার আপত্তি আছে। কারণ ‘অনুবাদ’ কর্মে অনেক ক্ষেত্রেই অনুবাদকের স্বকীয়তার প্রভাব পরিলক্ষিত হয়, কিন্তু এখানে সেই স্বকীয়তার জায়গা ছিল না, সম্পাদক যদি স্বকীয়তা দেখাতেন ভাষান্তরে, তাহলে হয়ত কবিতাগুলির রসবিচ্যুতির সম্ভাবনা দেখা যেত। তাই ‘ভাষান্তর’ শব্দটি অধিক গ্রহণযোগ্য।
    প্রথমেই কবি ‘মেচ’ কবিতাগুলিকে সাজিয়েছেন, যা বিভিন্ন কবির কিন্তু প্রতিটা কবিতার মূলসুর একসূত্রে গাঁথা তা হল উত্তরবঙ্গের পার্বত্য প্রকৃতি। তাই এর বিষয়বস্তু রূপে আসে ‘ডŠমৈলŠ ডুয়ার্স’ অর্থাৎ ‘সৌম্য শান্ত ডুয়ার্স’। সম্পাদকের ভাষান্তরে যখন কবির বক্তব্য আমাদের কাছে আসে ‘কিন্তু ডুয়ার্সের শান্ত মেঘমালার কাছে পৌঁছাতে/জয়ন্তীর পাথরে, ফুল ফোটাতে হবে।’ তখন এর অন্তর্নিহিত জনজাতির জাগরণ ভাবনার থেকেও কবিতার প্রাকৃতিক সৌন্দর্য আমাদের মুগ্ধ করে। ‘রাভা কবিতায়’ অনেক বেশি মানবীয় গন্ধ। প্রকৃতি সেখানে এসেছে কিন্তু মানুষ এবং মানুষের জীবন প্রবাহের অনুষঙ্গে। ‘বসন্তের বিদায় লগ্নে/বেদনার অনুরাগে/উদাসিমন একা একা কাঁদে’ — সুশীল কুমার রাভার ‘হাপাগ রিমা’ কবিতার এ বক্তব্য সুস্পষ্ট। মানব জীবনে বসন্তের ন্যায় যৌবন — কিন্তু বসন্ত ও যৌবন দু’জনেই ক্ষণস্থায়ী। তাই উভয়ের চলে যাওয়া কবি মনে যে বিরহের সঞ্চার ঘটায় তা অনুরণিত হয় পাঠক হৃদয়ে। পাঠকও যেন অনুভব করেন প্রকৃতির বিদায় লগ্নে যৌবনের বিদায় আমাদের জীবনকে জরাতুর করে দেবে। ‘গারো কবিতায়’ ডুয়ার্সভূমি’কে যে অনবদ্য-ভাবে ধরা পরেছে, যে ছন্দ কবিতাটির ছত্রে ছত্রে তাতে ভাষান্তর ছাড়াই কবিতাটি একটি সুখপাঠ্য হতে পারে। কবিতার ভাবনা বুঝতে পাঠকের অসুবিধা হয় না — ‘জলপাইগুড়ি জিলানি বিজাটচিও/ভুটান আ অব্রিনি জাআআ রেকো/দংআ-সং দামসা,/উয়ান, কআআ বেয়াসং,’। তামাঙ কবিতাগুলির মধ্যে কাজীমান গোলের ‘চারদম’ কবিতাটি একটি বিশেষ অর্থে তাৎপর্যপূর্ণ। সেখানে কবি উত্তরবঙ্গে ‘কন্যাদান’কে বিশেষ লোকসংস্কৃতি আবহে নির্মাণ করেছেন। টোটো কবিতায় অনেক বেশি আঞ্চলিকতা স্থান পেয়েছে। ধনীরাম টোটো, সঞ্জীব টোটোদের কবিতায় ‘টোটো’ অঞ্চলের নিজস্বতা শব্দ রূপ পেয়েছে। কুরুখ ভাষার বিস্তৃতি উত্তরবঙ্গ সীমানা ছাড়িয়ে ঝাড়খণ্ড রাজ্যেও তাই কুরুখ কবিতায় ডুয়ার্স-এর পাশাপাশি ঝাড়খণ্ডের প্রাকৃতিক সৌন্দর্য এসেছে যা পাঠককে এক বিচিত্রতার স্বাদ এনে দেয়। তবে বিমল টপ্পো’র লেখা কুরুখ কবিতা ‘উড়িয়ারী’ কবিতাটির নামকরণের বাংলা ভাষান্তর নেই। সম্পাদকের অনিচ্ছাকৃত ত্রুটি নাকি মুদ্রণ প্রমাদ তা সুস্পষ্ট নয়। কারণ প্রতিটা কবিতার নামকরণের বাংলা ভাষান্তর রয়েছে তাই এই কবিতাটির ক্ষেত্রে এই ব্যতিক্রমী বিষয়টি বড্ড চোখে পড়ার মতো। সম্পাদক যে সমস্ত লিম্বু কবিতা সংকলিত সবগুলিই সংগৃহীত কবিতা। যা ঐ সকল অঞ্চলে প্রচলিত। প্রতিটা কবিতার বিষয়বস্তুই জনজাতিকে উদ্দেশ্য করে জাগরণের বাণী। তবে কবিতাগুলির মাধ্যমে লিম্বু সংস্কৃতির ক্ষুদ্র কিন্তু পরিপূর্ণ একটি চিত্র আমাদের সামনে উদ্ভাসিত হয়। নেপালি কবিতায় অনেক বেশি স্থান পেয়েছে ডুয়ার্স — ডুয়ার্সের সৌন্দর্য, ডুয়ার্সের লোকসংস্কৃতি এই কবিতাগুলির প্রাণ। পার্বত্য অঞ্চলে বিশেষত উত্তরবঙ্গের পর্বতে জলসঙ্কট একটি সর্বজনগ্রাহ্য অসুবিধা, তারও প্রতিচ্ছবি পাই ‘এক থোপা পানি’ কবিতাটিতে।
    কবিতাগুলি পাঠে শুধু উত্তরবঙ্গের আঞ্চলিক ভাষা পাঠ নয়, বিভিন্ন কবির কবিতার বিচিত্রতা ঐ অঞ্চলের লোক সংস্কৃতিকে আমাদের সামনে তুলে ধরে। আমরা কবিতার মাধ্যমেই করম জিতিয়া, বাগরুম্বা, মারুলি, বৈরতি নৃত্য সংস্কৃতির সঙ্গে পরিচিত হই। তবে কবিতাগুলির মধ্যে উত্তরবঙ্গের জনসমাজের শ্রমজীবী মানুষের পরিচয়, চা বাগানের কাজ হারানোর বেদনা, শ্রমজীবী হিসাবে নিজেদের অস্তিত্ব জ্ঞাপনের সে প্রয়াস রয়েছে তা নিঃসন্দেহে আমাদের মুগ্ধ করে; পরিচিত হই আমরা সেই জনজাতির সঙ্গে — ‘হামরে কিষাণ হামরে মজদুর / হামরে ভারতবাসী / নাখে হামর জাইত ধরম হো / নেপালি আদিবাসী।’ কবিতাগুলি পাঠে পাঠক মানস পরিভ্রমণে অবশ্যই পৌঁছে যেতে পারেন উত্তরবঙ্গে।
    কবিতাগুলির কবিদের সামান্য পরিচয় এবং কবিতাগুলির রচনাকাল যদি সম্পাদক আমাদের সামনে উল্লেখ করতেন তাহলে তা আরও তথ্যনিষ্ঠ ও গবেষণাধর্মী হয়ে উঠত। সম্পাদক রাজবংশী কবিতার কোন ভাষান্তর করেননি কারণ রাজবংশী বাংলা ভাষারই একটি আঞ্চলিক উপভাষা। কিন্তু মান্য বাংলাতে কবিতাগুলি ভাষান্তর করলে অনেক পাঠকের কাছে তা আরও প্রণিধানযোগ্য হত। কারণ দক্ষিণবঙ্গের মানুষ যারা রাজবংশী ভাষার সাথে পরিচিত নয় তাদের পক্ষে এর রস আস্বাদন খুব সহজসাধ্য নয়। দি সী বুক এজেন্সি প্রকাশিত গ্রন্থটির সুন্দর ছাপা, নির্ভুল বানান পাঠক হিসাবে এই গ্রন্থপাঠে আরাম দেয়। তবে গ্রন্থের সূচনায় সম্পাদকের এই পরিশ্রমলব্ধ প্রয়াসের সমালোচিত একটি ভূমিকা কাম্য ছিল। এর পরবর্তী সংস্করণে প্রকাশক তা সংযোজিত করলে পাঠক হিসাবে সমৃদ্ধ হতে পারা যাবে।

গ্রন্থ সমালোচনা -
এক আকাশ অনেক মানুষ — সম্পাদনা - প্রমোদ নাথ
দি সী বুক এজেন্সি, কলকাতা—৭০০ ০০৭
মূল্য—একশো টাকা
পৃষ্ঠা সংখ্যা - ১০৬