পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন মানভূম অঞ্চল সামাজিক সাংস্কৃতিক এবং নৃ-গোষ্ঠীয় পরিচয়ে একটি ভিন্নতর অঞ্চল। এই অঞ্চলের মূল নিবাসীরা মূলত দুটি গোষ্ঠীতে বিভক্ত; যথাক্রমে অস্ট্রিক ও দ্রাবিড়। উক্ত জনগোষ্ঠীয় বিন্যাসের দ্বারা এই অঞ্চলের সাংস্কৃতিক ঐতিহ্যে বিমিশ্রণ তথা সমন্বয় লক্ষণীয়। মানভূমের আর্থ-সামাজিক অবস্থার ভিত্তিভূমি মূলত কৃষিকেন্দ্রিক।
ড. নিমাই কৃষ্ণ মাহাত স্বভাবতই মানভূমের লোকায়ত
ঐতিহ্যে কৃষিসংস্কৃতির ধারাকে অনুধাবন করে গ্রন্থটির শিরোনাম দিয়েছেন ‘মানভূমের কৃষিসংস্কৃতি’। মানভূমের আদিম অধিবাসীদের কৃষিজীবন-কেন্দ্রিক ধারাকে অনুসরণ করে মূল নিবাসীদের সামগ্রিক সত্তাকে অনুধাবন করেছেন।
গ্রন্থটি পাঁচটি অধ্যায়ে বিন্যস্ত। প্রথম অধ্যায়ে পুরুলিয়া জেলা ও তৎসংলগ্ন অঞ্চলের ঐতিহাসিক, নৃতাত্ত্বিক ও পরিবেশগত প্রেক্ষাপট তুলে ধরেছেন। দ্বিতীয় অধ্যায়ের মূল বিষয় পুরুলিয়া জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলের মূল নিবাসীদের পরিচয়। এখানে মূলনিবাসীদের পরিচয়ের পাশাপাশি গবেষক মাহাত ভাষিক পরিচয়ও প্রদান করেছেন। তৃতীয় অধ্যায়ের মূল বিষয় পুরুলিয়া জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলের প্রচলিত কৃষি সংস্কৃতির পরিচয়। বলা যায় এই অধ্যায়ে গবেষক ড. নিমাই কৃষ্ণ মাহাত কৃষিজীবনকে নৃ-তাত্ত্বিক ও ভাষাতাত্ত্বিক প্রেক্ষিতে বিজ্ঞানভিত্তিক পর্যালোচনায় উপস্থাপিত করেছেন যা লোকসংস্কৃতি চর্চার ইতিহাসে অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ। চতুর্থ অধ্যায়ে লেখক পুরুলিয়া জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলের মূলনিবাসী কৃষকসমাজের দৈনন্দিন জীবনে প্রচলিত কৃষিব্যবস্থার মধ্যে লোকঐতিহ্য কিভাবে বিন্যস্ত হয়ে আছে তার ব্যাখ্যা বিশ্লেষণ করবার চেষ্টা করেছেন। লোকসমাজের প্রবাদে কৃষিপ্রসঙ্গ বারবার কিভাবে ফিরে আসে তার দৃষ্টান্ত আছে যথেষ্ট। এছাড়াও বিভিন্ন রীতিনীতি, ধাঁধাঁ, লোককথা, লোকগীতি কিভাবে মানভূমের কৃষিজীবনকে একটি সাংস্কৃতিক চিহ্নায়ন নির্দিষ্ট করে দিয়েছে তারও প্রমাণ আছে যথেষ্ট। ষষ্ঠ অধ্যায়ের শিরোনাম পুরুলিয়া জেলা ও সংলগ্ন অঞ্চলের কৃষি উৎসব ও পালাপার্বণে কৃষিসংক্রান্ত লোকবিশ্বাস। সবশেষে কৃষিসংস্কৃতির সঙ্গে সঙ্গতিপূর্ণ কিছু ছবি গ্রন্থের বিষয়টিকে সমৃদ্ধ করেছে। তবে লোকসংস্কৃতির পদ্ধতিগত আলোচনার অবকাশ আছে যথেষ্ট। গবেষক তার মধ্যেও যেভাবে মানভূমের কৃষিসংস্কৃতি তুলে ধরেছেন তা নিঃসন্দেহে মানভূমি সংস্কৃতির অখণ্ড মানচিত্র।