লোধা ভাষায় রচিত গীত - ধীরেন্দ্র নাথ মল্লিক

খাটিঞ খাই কনে কঁধায়
    গড়িঞ থাই। তভু তিথি কিলা
বাডিঞ উঠে বেয়াড়া। গাঁঞ গঁজড়ের
    বাবুরা গমে গমে দিঁঞ গেলহিন পাকনাড়া।
ঘড়িসাঁত নেহানেপা করিঞ গেলহিন
পাউড়ি নাপিঞ সেক দিলহিন।
    ফেঁর তিথিকিলার বাতলাতে যাঁঞ
বাবুরা দিঁঞ গেলহিন গোময়ের জলছড়া।
    নাটা বুদার কাঠ আর হাটালীর
খরদি করা ডাইডোলে খেঁটন মাইর।
    বাবুরা খাঁটাঞ গেলহিন ইন্তিজারি।
জুহের ডাহে গুড়ুসুড়ু দিঁঞ রহা।
আমরাকার পিড়ির পিড়ি
    তিন পিড়ির ভিটা।
গারদখানার বাবু কহিঞ গেলহিন
    ফেড় তুরহাকার পাটা।
জাল বিছাছন চতুর বাটে, খেদার তরে
    বাবুরাকার রাইতে দিরবসে চালাছন 
                                    গনহা পড়হা।
বাংলা তর্জমা —
গায় গতরে খেটে পরিশ্রম করে আমরা পেটের ভাত জোগাড় করি। ছোট্ট কুঁড়ে ঘরে থাকি। দেখে সহ্য হয় না। গাঁয়ের জোতদার বাবু নানা কারন খাড়া করে তাদের উপর নির্যাতন করে।
বিভিন্ন কায়দায় আক্রমণ করে। কাদার উপর পায়ের ছাপ মিলিয়ে দোষী সাব্যস্ত করে। এই নালিশ কোথাও জানাবার জায়গা নেই। ঘৃণা ও অবজ্ঞা তাদের দিকেই আসে।
জঙ্গল থেকে কাঠ সংগ্রহ করে এবং হাট থেকে চাল কিনে খেয়ে বেঁচে থাকে। কিন্তু জোতদার বাবুরা তাদের হুকুমে চলতে বাধ্য করে।
তারা তিন পুরুষের ভিটে মাটিতে বসবাস করত। তাদের বসত বাড়ীর কোন কাগজ ছিল না। কিন্তু থানার পুলিশ সেই ভিটে মাটির কাগজপত্র দেখতে চান। জোতদার সেই বাস্তুভূমি থেকে উৎখাত করার জন্য দিনরাত্রি নানা ধরনের চক্রান্ত আর ষড়যন্ত্র করে চলেছে।
— ০ —
লোধা গীত
মাইশোরে গুপ্তমনির পূজা হঁঞ চলে গো
পরবে, মাডই দেহেরীরা দিলহিন গো
বেকড়া, হাঁউশীরা জুড়লিন গো আখড়া
উরহাকার জুড়াই গুনজা নাটা ফুলের
কুনডি, আমহাকে চাঙয়ার পাট বাতলাঞ
ছিঁঞ, ভিড়াঞ গেলা রে নেশাড়িয়া ছঁনডি।
উগাঁঞ নিয়ালে তুঁঞ গানের কলি, তাল
দিলাই চাঙে, আনিকোটে যাঁঞ রহিঞ
গমে গমে মনটা মহর ভাঙ্গে, ও আনিকোটে
যাস নাই তুঁঞ, আখড়া ছাডিঞ যাস নাই
যাইস্ নাইরে হাঁউশি ছাডিঞ,
হাজারো সাল পাইরাঞ আখড়া চলে গো
গাঁয়ে, পূজা পাঠ আর নাচে গানে চাঙের
বাজন বাজাঞে, কলির আইগনে বজড়িঞ হঁঞ
হাতি আর ঘোড়া নাম নিলহিন গুপ্তমনি
কন বা বড়াম বু্ড্ডি।
নীল কন্দরে বিশ্ববসু শবরের আখড়ায়
ডাকসাধিয়া মুকডেট দিঁঞ গেথিন পুরানে
আখড়ায় আখড়া দিথিন চাঙের গানে, ফেঁর
বিদ্যাপতি গাঁঞদা নাগাঞ, গাঁয়ের গরামকে
নিঁঞ গেলহিন গো ভাতিঁঞ।।

বাংলা তর্জমা —
পৌষের সংক্রান্তির দিনে লোধা-শবর সমাজে প্রচলিত দেবদেবী গুপ্তমনি ও শীতলা মায়ের পূজো উপলক্ষে তাদের গাঁয়ের মন্দিরে পূজো এবং উৎসব হয়। দেহেরী বা পূজারী ঝুপার পড়ে পূজো করে। তার সুবাদে চাং নৃত্য শিল্পীদের আখড়া বসে। তাদের পরস্পরের মধ্যে লোক সমাগম বাড়ে। মন হাত বাড়ায় প্রেম প্রীতির দিকে।
আখড়া মঞ্চে চাং নৃত্যকারী বা (নায়িকা) গানের সুর তুলে নৃত্য করে আর নায়ক চাং বাজিয়ে নৃত্যের জোগান দেয়। নায়ক তার নিজস্ব ভঙ্গিতে বলে তুমি দূরে যেও না, নৃত্য ছেড়ো না। উদ্যোগ যাতে না ভাঙ্গে সেদিকে নজর রাখতে বলেন।
দেবদেবীর আরাধনা গাঁয়ে হাজার বছরের বেশি সময়কাল ধরে হয়ে আসছে। পূজো আর নৃত্যে কেবল চাং বাজিয়ে। কলিযুগে দেহ পালট পোড়া মাটির নির্মিত হাতি-ঘোড়া দেবত্বের স্থানে বসিয়ে কোথায় গুপ্তমনি এবং শীতলার নামকরণ হয়েছে। পুরানে বর্ণিত নীল কন্দরের পূজারী বিশ্ববসু শবর তার নিজস্ব আখড়ায় দেবত্বের প্রকাশ্যে আবির্ভাব এবং কথা বলা আজও লোধারা মানে।
তৎকালিন বিদ্যাপতি ঠাকুরের খোঁজে গোয়েন্দা চালিয়ে চাতুরী করে গাঁয়ের দেবতাকে নিয়ে পলায়ন করে।
— ০ —

লোধা গীত
চাং নাচে ভেটা ভেটি মেল দিলহিন পিঠাপিঠি
ও ছঁনডি মন বাহলেক গো ডেনা,
চোল গিজাখিন তা না নাই রে না না, ও তানা না না।
আখড়ার হাঁউশী তুঁই, চাঙের নাচনী তুঁঞ
মহর সঙ্ঘে জুড়িটুকু বনা, মোর আখড়ায়
হাঁউশী নাই, মনটা হঁঞ উঠে গো ধূড়মানা।
ঝিলিমিলি শাড়ী খরদি করিঞ দিব তোকে
লোধা শূলীর বাজারে, মাইশোরে তোকে নিঁঞ
নাচতে যাব গুপ্তমনির পরবে, এই নাচের গাদালে
মুঁঞ ভিড়াঞ যাব, পাঞ্জিঞ বুলি নছনা।
একদিন কলকাতা শহরে চাং লাচের আখড়া
বসাব, জঙ্গলা গাঁয়ের অফসোরিকে
নাচনী বনাব, সাহেবী ঢেলার মাঝু বিখরাঞ
ইদন চাঙেরী গাঁওনা।
বাংলা তর্জমা —
চাং নাচের আসরে নাচ করতে গিয়ে পরিচয় হল চাং বাদ্যকার ও নৃত্যশিল্পীর মধ্যে। তাদের মনে মন ডানা মেলল। তারা পরস্পর প্রেমের বন্ধনে বাঁধা পড়িল। বাদ্যকার নৃত্যশিল্পীকে উদ্দেশ্য করে বলে, তুমি নৃত্যকারী, তুমি উদ্যোগী। একটু যদি বন্ধুত্বের হাত বাড়াও তাহলে এগিয়ে যাবে আমাদের চাঙের গান।
আমার আসরে খরা বইছে। বহু দিন ধরে কোন নৃত্যকারী নেই। যদি তুমি রাজী থাক, তাহলে তোমাকে লোধা শূলীর বাজার থেকে শাড়ি কিনে দিবো। এবং গুপ্তমনির পূজোতে তোমাকে নিয়ে নাচতে যাব। যদি সুযোগ মেলে একটু আধটু ভালবাসার কথাও তোমাকে জানাব।
এমনি করেই একদিন কলকাতার শহরতলিতে তোমাকে নিয়ে চাং নাচের আসর বসাতে চাই। জঙ্গলা সুন্দরী যদি আমার পাশে থাকে। সেখানে সাহেব, জ্ঞানী, গুণিজনদের সামনে চাং গানের আর্দশ ও ঐতিহ্যকে তুলে ধরার অঙ্গীকার ব্যক্ত করে।
— ০ —
লোধা গীত
ভিড়তে যাঁঞ ভিড়কিঞ গেলা, একটু
ভিড়াঞ যা, ঢালে মেলে বেঁঝাঞ গেলে, তাল
দিঞ যা। তাল দিতে যাঁঞ তালের সুঁডায়
দিলহিন গো বেগড়া। পিরিতির আখড়াটা
মহর ভন্ডুর হ্যঁঞ গেলা।
ভিড়লে তো ভিড়াঞ যাব, কনহ দিন
ইগজুঞ্জিঞ যাব, তোকে নিঁঞ জুড়ি করার
তরে, পাঁদাড়ে জানিঞ পাবে ঠেলা।
তুরহাকার পাড়ার মাউশি কহন, আমরাকার
নাটা দিঁঞ সাঁঞ আসিঞ সুড়া ফেলাঞ
দিলহিন, বেহার নামে তর বাপ্পে মাঞ
আমহাকে ভাঁনড জুঝাঞ গেলহিন
সেও নিঁঞ খাতুমে বাজছে তিথিকিলা।
কনহ দিন বেলা চাকে বসার তালে, ছঁনডি
মকে ইসরা করিঞ চালে, সে দিনাকে
রাতটাকে জল ফুটালাই ঢেলার উপর
রাখিঞ দিঁঞ ঢেলা।

বাংলা তর্জমা —
গাঁয়ের রকে রোজই এক প্রেমিক ও প্রেমিকার দেখা মিলত। তাদের মধ্যে ভাব জমে উঠে। তারা পরস্পর সামনে এগিয়ে এল। একদিন হঠাৎ করেই প্রেমিকার আর দেখা মিলল না। প্রেমিকের মন ভেঙ্গে যায়।
একদিন প্রেমিক তাকে বুঝিয়ে বলল তুমি চাং নাচ করতে জান, তুমি বড় উদ্যোগী। কিন্তু আসরে নৃত্য শিল্পী নেই। তোমাকে আমার খুব প্রয়োজন। তুমি সে কথা বুঝতে চাও না। হয়ত আমি একদিন মারা পড়েছি। পরে তুমি অনুতপ্ত হবে।
তোমার পাড়ার মাসি লোকের কাছে বলে বেড়াচ্ছে ওদের দু-জনের মধ্যে মেলামেশা বেড়েই চলেছে। তথাপি তোমার মা, বাবা, আমার সাথে বিয়ে দিতে রাজী নয়।
হেনকালে একদিন সূর্য্য ডুবার আগে নায়িকা নায়কের কাছে ধরা দিল। উভয়েই প্রেমপ্রীতির বন্ধনে মিলিত হল। তাদের জীবনে সে দিনের রাত্রি এক স্মরণীয় মুহূর্ত হয়ে থাকল।
— ০ —
লোধা গীত
ভাকু খাঁঞ খুয়ার দিলহিন বেল্লি গিনহা
সবু কিছু গজলাই দিঞ পেটে কি দিবে অদাকানা
তুরহা শিল শালহঁঞ টাউটারী মারাঞগেলহ
হিঁসকাকে করল বেহদ, তুরহাকার শিল শালকে
গোড্, তুরহাকার ভাকু খ্যওয়াকে গোড।
নাই নিঞ ঝন্তিপালের ধাঁকাতালা আপোহারাইতে
বাপ্পে মাঞ উডিঞ দিলহিন মুক আঁধরাঞ ঘুরিঞ
আসিঞ পুবুর গুবুর ভাটিশালে বজডিঞ
গেলহিন, রাইতে দিরবসে ধঁদকুট বাচিঞ উঠে 
ও তার বাঢে অজলত।
গুডুরের বখার হলে খড়িক্যালের কাছে যাঁঞ
তেল খড়ি পাতে, নাজ মাডায় নিজাম ঠারে
বাতলাতে, বাখুলের ঝিউড়ি ছেনা গমেগমে
বাডিঞ উঠে, বেহা দিবার ভেলকিড়সামটান
নাই, কুড়িয়াটাই শাঁঞে শুঁঞ শবদ,
বুডি মাঞ বখার হঁঞ পড়িঞ আছে আঁধারে
বুহে বেটাই উডিঞ দিলহিন শুসরাই ঢিপার
পগারে, এ্যা বাটে জড়িবুটির খাকতি দেখিঞ
আধেক ধূরায় রাখলিন রে রথ।

বাংলা তর্জমা —
অভাবের সংসারে খাওয়ার নেই বাড়ীতে, অথচ থালা, বাটি বন্ধক দিয়ে মদ খেয়ে যাচ্ছে। এভাবে দিনের পর দিন ধ্ৱংসের পথে এগিয়ে যাচ্ছে। বাইরে সেজে গুজে ভদ্রতা দেখালেও ভিতরের অভ্যাস বড় খারাপ, তাই তোমাদের সাজবাজকে ধন্য এবং তোমাদের মদ খাওয়াকে ধন্য বলেছে এই চাঙের গানে।
রাত্রির শেষে অন্ধকার থাকতেই খাবারের জোগাড়ে দূর দেশে চলে যায়। বাড়ীতে থাকে ছোট ছোট বাচ্চা। তাদের দেখভালের কোন লোক থাকে না। তাদের মা, বাবা সন্ধ্যায় বাড়ী ফিরে আসে। তো আসার আগে মদের দোকানে ঢুকে বাড়ী আসে। সন্ধ্যায় রান্না চড়ে আর ঝগড়া ঝাটি হতে থাকে। এভাবে রাত্রি শেষ হয়ে যায়।
গুন্ডুর একজন ব্যক্তি তার জ্বর জ্বালা হইলে সে থানগুরুর কাছে যায়। সেখানে তেল খড়ির সাহায্য রোগ নির্ণয় করে এবং সে নিজের মাতৃভাষায় কথা বলতে লজ্জাবোধ করে। তার বাড়ীতে বিয়ের উপযুক্ত একটি মেয়ে আছে। তার বিয়ের জন্য একটিও টাকা জোগাড় নেই।
অন্ধকার ঘরের কোণে বৃদ্ধা মা অসুস্থ অবস্থায় পড়ে আছে। এই অবস্থা যখন ৭-৮ দিন পেরিয়ে যাচ্ছে দেখে, তার একমাত্র পুত্র এবং পুত্রবধূ শ্বশুরবাড়ি চলে যায়, কিন্তু বাড়ীতে অসুস্থ মাকে কেউ দেখার লোক না থাকার জন্য পরলোক গমন করেন।
— ০ —
লোধা গীত
ভকে হোরল বিকল করে নূলহু ছা,
এ্যা নূলহুর বাপ্পে তুঁঞ
আধার পাঞ্জিঞ যা। কঁধাই তাড়িঞ
আনিঞ রাখছি মুঁঞ ওল, বাঁওলা তুরহা সিঝাহা।
মাংগার ঠানি ভক, সস, পানি, গমে গমে
আয়মাটা অদরে, নূলহুর বাপ্পেকে
পাকড়ো করিঞ নিঁঞ গেলহিন জিহল
খানার গারদে, তুরহাকার ঘরে বারামে
কে দিলহিন হুলা, তার উপর ঠুকিঞ দিছন
আছিলা, তুঁঞ কুনটা পোহাবে যাঁঞ পোহা
অধিয়া পিঁঞ খামিদের বারামে, একসের
সিধাই পাঁচটা মুনিশে গতর বাঁধা দিলহিন
জয় নেগুড় বাঢায় বাঢায় ভুরকুনডায়
ধূঁয়া উডাঞ গেলহিন, খামিদ ভায়া হুড়িয়া
করে, খামিদের পো চালায় ঠ্যাংগা।
মাইশোর হেজগেড়াই পরব নজকে,
তভু কুড়িয়ার মানমির ভেট নাই।
উরহাকার তিথিকিলা ভেটাঞ মুঁঞ
চাঙের খাতায় নেখিঞ গেলাই পুক দশা।

বাংলা তর্জমা —
ক্ষুধার জ্বালায় কাঁদছে শিশু, মা শিশুর বাবাকে খাবার জোগাড় করে আনতে বললেন। শিশুর বাবা বলছে গতকাল জঙ্গল থেকে বনআলু, ওল জোগাড় করা আছে, সেগুলি সিদ্ধ করার ব্যবস্থা কর।
গাঁয়ে প্রচণ্ড খাদ্যের অভাব। কাজ নেই। কি পোড়া কপাল আমাদের। অপরাধী সন্দেহে শিশুর বাবাকে থানার পুলিশ হাজতে নিয়ে গেছে। গ্রামের চাষীর নিকট থেকে এক কিলো চালের বিনিময়ে পাঁচটা মজুরে চুক্তি করে তারা পেট চালায়। পরে মজুরী খেটে দেনা পরিশোধ করে। কিন্তু সুদের দরুন দেনা আরও বাড়ে। এমনি করেই একদিন গ্রামে উৎসব এল। এই আনন্দের দিনে শিশুর মা ভাবছে আর কান্নায় ভেঙ্গে পড়ে, কেননা শিশুর বাবা এখনো জেলখানায় বন্দি রয়েছে। সে এখনো মুক্তি পায়নি।