ইন্দ্রনীল - আপনার সম্বন্ধে কিছু বলুন।
ললিত - আমি জঙ্গলমহলের একজন সাহিত্যিক। আমি বাংলাভাষাতে লিখি। কিন্তু যখনই সংলাপ আসে, পাত্রপাত্রীদের কথোপকথন আসে তখন তাদের নিজেদের ভাষাটা আমি ব্যবহার করি। প্রথম যখন আমার সাহিত্য বোধের উন্মেষ ঘটে তখন থেকেই এখানকার মানুষের কথা বলার চেষ্টা করেছি। আমার সাহিত্যের আসল সময় ১৯৭০ থেকে ২০০০ পর্যন্ত। ২০০০-এর পর ধারাটা একটু কমে গেছে। এই সময় মহাশ্বেতাদির সাথে আমার আলাপ হয়েছে। ১৯৭৮ সালে বসুমতীতে আগুন নামে প্রথম একটি গল্প প্রকাশিত হল। সেটির পাত্রপাত্রী লোধা ছিল। লোধা জাতের যে সামাজিক অবস্থাটা, যেমন তাদের যে একটা চুরি করার প্রবৃত্তি ছিল মানে এখন নেই কিন্তু আগে মারাত্মকভাবে ছিল। ওরা যে সিন্দকাটি দিয়ে চুরি করত, মাটির দেওয়ালে গোল করে কেটে ঢুকত এবং ছাগল, মুরগি, ধান এবং অন্যান্য জিনিস চুরি করে পালাত। তার উপর ভিত্তি করে গল্পটা লেখা ছিল। ১৯৭৮ সালে যখন এটি প্রকাশিত হয়েছিল তখন বিভিন্ন সাহিত্যিক ঝাড়গ্রাম এবং কলিকাতার যেমন সুনীল গঙ্গোপাধ্যায় এবং শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, এঁরাও গল্পটার খুব সুনাম করেছিলেন। মহাশ্বেতাদি তখন আমাকে ডেকে পাঠিয়েছিলেন। তিনি সাহিত্যিক অমর মিত্রের মাধ্যমে (যিনি বেলেবেড়ার দিকে চাকরি করতেন) ডেকে পাঠিয়েছিলেন। কারন তখন তাঁর পিতা মারা গেছেন এবং তিনি বর্ত্তিকা পত্রিকাটি আরম্ভ করেছেন। তিনি প্রধানত লোধাদের জীবন কাহিনী বিশেষভাবে প্রকাশ করতে চেয়েছিলেন। সেই সূত্রে আমার ঐ লেখাটি দেখে বলেছিলেন ললিতকে ডেকে নিয়ে এসো। তখন তিনি বালিগঞ্জ স্টেশন রোডে থাকতেন। তাঁর সাথে আমার আলাপ পরিচয় হল। তাঁকে প্রণাম করলাম। দিদি আর ভাই সম্পর্ক হল। তুমি আসবে এবং আমার বর্ত্তিকার জন্য লিখ। আমার লেখাগুলি দেখেই বুঝতে পেরেছিলেন যে এরপর যে লেখাগুলি বেরুবে সেগুলি মূলত লোধা, কুড়মি, ভূমিজ, সাঁওতাল, ডোম ইত্যাদির উপর পাত্রপাত্রীরা থাকবে। তখন আমি বর্ত্তিকাতে বড় বড় প্রবন্ধ লিখেছি। ‘অপরিচয়ের অন্ধকারে লোধা উপজাতি’, ‘অপরিচয়ের অন্ধকারে ডোম উপজাতি’, ‘অপরিচয়ের অন্ধকারে শবর উপজাতি’। সর্বপ্রথম আমি লোধাদের তিনজন লোধার সাক্ষাৎকার নিয়েছিলাম। প্রথমে চুনি কটাল-এর সাক্ষাৎকার সাপ্তাহিক দরকার পত্রিকাতে বেরিয়েছিল। সেই সাক্ষাৎকার পড়ে তৎকালিন এস. ডি. ও লোধা মেয়েটির পড়াশুনার দায়িত্ব নিয়েছিলেন। এর ফলে চুনি স্নাতক হয়েছিল। এরপর স্নাতক হিসাবে প্রথম পেয়েছি প্রহ্লাদ ভক্তাকে। তিনি ছিলেন লোধা সমাজের একমাত্র গ্রাজুয়েট। তাঁর সাক্ষাৎকার নিয়েছি। আমি জঙ্গলমহলে সর্বত্র ঘুরেছি। পুরুলিয়ার বান্দোয়ান থেকে কানু শবর বলে এক লোধার কাছে যাই কারণ সে একমাত্র স্বদেশি করেছিল। তখন বিদ্রোহ হয়ে গিয়েছিল — চুয়াড় বিদ্রোহ, নায়েক বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ হয়েছিল। সেখানে আর একজন কুড়মি সম্প্রদায়ের মানুষ ছিলেন। তাঁর সাথে সাক্ষাৎ করতে পারিনি। কানু শবরকে পেলাম একমাত্র লোধা সমাজের স্বাধীনতা সংগ্রামী।
সুবর্ণরেখার পার্শ্ববর্তী অঞ্চলে আর একটি বাংলার উপভাষার উদ্ভব হয়েছে যাকে বলা হয় সুবর্ণরৈখিক ভাষা। এই সুবর্ণরৈখিক উপভাষার সাথে কুড়মালির প্রভাব মিশে গেছে। বিহারে হিন্দির সঙ্গে মিশে গেছে। বাংলায় আমাদের বাংলার সঙ্গে মিশে গেছে। কিন্তু আসল কুড়মালি ভাষা বলতে জয়ন্তবাবু যে ভাষা বলছে বা যে হরফ আবিষ্কার করেছে সেগুলি। আমার লেখাতে আমি বাধাপ্রাপ্ত হয়েছি বেশি। আমার প্রধানত তিনটি বই প্রকাশিত হয়েছে। একটি ‘জঙ্গলিফুল’, ‘গল্প সংকলন’ এবং আর একটি ‘চাষির হাল’। এইগুলি আঞ্চলিক কুড়মালি ভাষায় লেখা। একটি আছে ‘একাঙ্কিয়া নাটিকা’। ওটা খুব প্রচার হয়েছে। এটা খুব ছোট চটি বই। খুব বিক্রি হয়েছে। এটা অভিনীতও হয়েছে। আমি চাইলেই ছোট ছোট বই প্রকাশ করতে পারি। কিন্তু আমার আশাটা একটু বড়। আমি চাই আমার বই একটু বড় আকারে প্রকাশিত হোক। কিন্তু আর্থিক সহায়তা না থাকার জন্য আমি পারিনি। এইজন্য মাস ছয়েক আগে মুখ্যমন্ত্রীর কাছে একটা ইমেল করেছিলাম এবং একটা দরখাস্ত করেছিলাম। কোন উত্তর পাইনি। এস.ডি.ও. নকুল মাহাতোকেও একটা কপি দিয়েছিলাম। অনগ্রসর মন্ত্রী চুড়ামনি মাহাতোর কাছেও কপি দিয়েছিলাম। আমি এস.ডি.ও.-কে বলেছিলাম, মুখ্যমন্ত্রীতো এখানে আসেন, আমাকে জঙ্গলমহলের সাহিত্যিক হিসাবে দুই মিনিটের সাক্ষাতকার করে দিতে পারেন ? কিন্তু তাঁরা পারেন নি। আমি রাজনৈতিক নেতাদের এবার বলব।
লেখকের পরবর্তী প্রকাশের অপেক্ষায় -
বিদ্রোহী অচল সিংহ (ঐতিহাসিক উপন্যাস)
জংলী যৌবন (ঐতিহাসিক গল্প সংকলন)
মেঘকন্যার অশ্রু (গল্প সংকলন)
বুদ্ধির দৌড় (ছোটদের গল্প)
দাবানল (জীবনী)
বুতনুয়ার দাড়ি (ছড়া ও হাসির কবিতা)
লড়াই (নাটক)
সীমান্তের সংস্কৃতি (প্রবন্ধ সংকলন)
অন্ধকারে লোধা ও সাঁওতাল উপজাতি (প্রবন্ধ)
রূপসী আসামের ডিব্রুগড়ে (ভ্রমণ কাহিনী)
ইন্দ্রনীল - এইসব বইগুলো পাওয়া যায় ?
ললিত - বের করব বলে তালিকা দিয়েছি। কিন্তু আর্থিক কারণে প্রকাশ করা
হচ্ছে না।
ইন্দ্রনীল - যদি কোন প্রকাশক করেন। তাহলে আপনি দেবেন তো ?
ললিত - প্রকাশক চাইলে আমি দেবো। সেই উদ্দেশ্যেই আছি।
ইন্দ্রনীল - প্রাথমিক লেখাটা তো আপনার কাছে আছে ?
ললিত - আছে।
মুখ্যমন্ত্রীকে লেখা ললিত মাহাতর চিঠি —
(সাক্ষাৎকার চলাকালীন ললিত মাহাত পাঠ করে শোনান।)
মাননীয়া
মুখ্যমন্ত্রী মহাশয়া, পশ্চিমবঙ্গ সরকার।
মহাশয়া,
আমার বিনীত নিবেদন এই যে, আমি জঙ্লমহল তথা ঝাড়গ্রাম থানার অন্তর্গত পুকুরিয়া গ্রামে বসবাসকারি একজন দুঃস্থ সাহিত্যিক। গ্রামে বসবাস করে উচ্চশিক্ষিত হয়ে ঝাড়গ্রাম শহরে একটি মাধ্যমিক বিদ্যালয়ে চাকরি করে জীবনযাত্রা নির্বাহ করেছি। তবে এই শিক্ষকতার বৃত্তি ছাড়াও, আমার জীবনে ছিল এক সাহিত্যিক সত্তা, যা আমার অন্তঃস্থলকে আলোকিত করে তুলত এবং তার সার্থক বহিঃপ্রকাশ ঘটাবার জন্য আমাকে ব্যাকুল করে তুলত। তবে আর্থিক সঙ্গতি ছিল না। তবুও নানান ঘাত প্রতিঘাতের মধ্যে সাংসারিক জীবনযাত্রা নির্বাহ করে, সাহিত্যিকে অন্তরে সযত্নে লালিত করে বিভিন্ন পত্র পত্রিকায় আমার ক্ষমতা অনুযায়ী বহিঃপ্রকাশ ঘটিয়েছি। এই সাহিত্য সাধনা, এত নিবিড়ভাবে অনুশীলন করতে গিয়ে আমার সাংসারিক জীবনের প্রতি যে দায়বদ্ধতা ছিল তা পূরণ করতে পারিনি। আমার হৃদয়ে সাহিত্যের অনুরণন, আমাকে ঘুন পোকার মত কুরে কুরে খেয়েছে। আর আমার জীবনের সেই অমূল্য সময়কে সেক্ষেত্রে ব্যবহার করতে বাধ্য হয়েছি। তাই সময়ে অসময়ে তীব্র আর্থিক অনটনে আমাকে ভুগতে হয়েছে। তবুও আমার ভিতরে সেই ভাস্বর সাহিত্যিক সত্তাটি আমাকে পশ্চিমবঙ্গের পশ্চিমাঞ্চলের বিভিন্ন গ্রামেগঞ্জে জঙ্গলে ঘুরিয়ে বেড়াতে বাধ্য করেছে। আমিও মানুষের সাথী হয়ে তাদের বঞ্চনার কথা, সুখদুঃখের কথা, তাদের বৈচিত্র্যপূর্ণ সংস্কৃতির কথা জনসমক্ষে আমার লেখনির মাধ্যমে উপযুক্তভাবে প্রকাশ করেছি। এতদঞ্চলের গ্রাম্য মানুষের জীবন কাহিনী, তাদের ঐতিহাসিক বিবর্তন ১৭৮০ খ্রীঃ থেকে ১৯০০ খ্রীঃ পর্যন্ত তিলকামাঝির বিদ্রোহ, পাইক বিদ্রোহ, নায়েক বিদ্রোহ, চুয়াড় বিদ্রোহ, সাঁওতালি হুল, বীরসামুণ্ডা হুলহুলান প্রভৃতি বিদ্রোহের অনেক অজানা তথ্য, তৎকালিন মানুষের জীবনযাত্রা, আমার লেখনীর মাধ্যমে প্রকাশের পথ পেয়েছিল। আমার সেই অক্লান্ত শ্রমের ফসল প্রকাশিত হয়েছে কলিকাতা, ঝাড়গ্রাম, রাঁচি, পুরুলিয়া প্রভৃতি জায়গার বিভিন্ন পত্রপত্রিকায়। আমার সাহিত্যকর্ম সর্বত্রই প্রশংসিত হয়েছে। আমার সাহিত্যের গুরু প্রণম্য মহাশ্বেতা দেবীর আশীর্বাদ আমার মস্তকে বর্ষিত হয়েছিল। কলিকাতার বুকে আমার লেখা ১৯৮০ সাল থেকে ২০০০ সাল পর্যন্ত প্রকাশিত হয়েছিল। প্রধানত বসুমতী, সত্যযুগ, পক্ষীরাজ, আনন্দবাজার, দেশ প্রভৃতি পত্রিকায়। মহাশ্বেতাদেবীর ‘বর্ত্তিকা’ পত্রিকায় আমার ‘অপরিচয়ের অন্ধকারে লোধা উপজাতি’, ‘অপরিচয়ের অন্ধকারে ডোম উপজাতি’ দারুণ সাড়া জাগানো লেখারূপে চিহ্নিত হয়েছিল। এভাবে মহাশ্বেতাদেবী, অন্নদামঙ্গল রায়, শীর্ষেন্দু মুখোপাধ্যায়, সুনীল গঙ্গোপাধ্যায়, কিন্নর রায়, তনাবসু মিশ্র, অমল মিত্র, ভগীরথ মিশ্র, নলীনী বেরা প্রমুখ বিখ্যাত সাহিত্যিকদের সঙ্গে আমার সাক্ষাত ঘটে এবং তাঁদের সান্নিধ্যলাভে আমি যথেষ্ট আনন্দ পেয়েছি। আমার সাহিত্য সাধনাকালে আমার নিজস্ব খরচে জংলীফুল গল্প সংকলন এবং চাষীর হাল নাটক প্রকাশ করেছি। এই গ্রন্থদুটি তিন মাসের মধ্যে ৩০০০ কপি বিক্রি হয়েছিল। আমার লেখা প্রবন্ধ, ছোটগল্প, কবিতা, ঝুমুরগান, উপন্যাসের অংশ বিশেষ ‘অচল সিংহ’ তৎকালিন মানুষ দারুণভাবে গ্রহণ করলেও বর্তমান প্রজন্মের নিকট আমার দ্রুত উপস্থিতি প্রাসঙ্গিকতা আমি দারুণভাবে উপলব্ধি করেছি। কারণ আমার বয়স ৭৮ বছর। অতএব মাননীয়া মহোদয়া আপনার নিকট আমার আকুল আবেদন এই যে, আমি যথেষ্ট দুঃখ দারিদ্রের মধ্যে অবস্থান করে, আমার জীবনের শ্রেষ্ঠ সময় প্রদান করে, যে অমূল্য সাহিত্য সম্পদ সৃষ্টি করেছি, তাকে স্থায়িত্ব দানের জন্য আমার সাহিত্যকীর্তির মধ্যে নির্বাচিত রচনাগুলি, অন্তত দুটি গ্রন্থ প্রকাশের জন্য প্রয়োজনীয় আর্থিক সাহায্য করে আমায় বাধিত করবেন। মুখ্যমন্ত্রীরূপে আপনার বিভিন্ন প্রকার উন্নয়ন কর্ম পশ্চিমবঙ্গকে ভারতের মধ্যে শ্রেষ্ঠত্বের পর্যায়ে উন্নীত করতে চলেছে তার জন্য আপনাকে একমাত্র দশভুজা দুর্গার সঙ্গে তুলনা করা যায়। তাই আমার এই পুস্তক প্রকাশনার জন্য আকাঙ্খিত অর্থ অনুমোদনের আবেদনে আপনার করুণা, সহৃদয় সহানুভূতি, আশীর্বাদ আমার উপর বর্ষিত হোক — এই প্রার্থনা জানাই।
নিবেদন — ইতি — বিনীত
শ্রী ললিত মাহাত
সাহিত্যিক জঙ্গলমহল
সুলগ্না - বহুযুগ আগেই আপনি ভাষা সংস্কৃতির বিপন্নতার বিষয়গুলি নিয়ে দৃষ্টি
আকর্ষণ করেছিলেন। আপনার নিজের কুড়মি ভাষা / কুড়মালি ভাষা
সম্পর্কে আপনার দৃষ্টিভঙ্গি কি ?
ললিত - আমি চাইছি, বর্তমানে এখানে যে কৃষয়া কমিটি (ঝাড়গ্রামে) তৈরী
হয়েছে, তার মাধ্যমে আসল কুড়মালি ভাষাকে respect করা দরকার।
সরকারের কাছে বা মানুষজনের কাছে একটা উপযুক্ত হরফ নিয়ে আসুক।
ভাষাটিকে আমরা নিজস্ব ভাষা বলছি। এর originality আছে বন্দু,
তামাড়, ঝালদা এই সমস্ত এলাকায়। সেটাকে যদি প্রচার ও প্রসার করা
হয় বা সে সম্বন্ধে স্কুল খুলে শিক্ষা দেওয়া হয় অথবা সরকারের অষ্টম
তফশীলে ভাষাটিকে যুক্ত করা হয় সেই আন্দোলনে আমার পূর্ণ সমর্থন
আছে। সেই চেষ্টাটা আমরা মঙ্গল মাহাত, জয়ন্ত মাহাত এবং এদের
কমিটির সভাপতি হিসাবে আমি উদ্যোগ নিচ্ছি। এই ভাষার যে হরফ
তৈরী হয়েছে তা সারা বিশ্বেই স্থান পাওয়া উচিত। এই হরফের মধ্য দিয়ে
কুড়মালি ভাষার আসল রূপটা ফুটে উঠুক। প্রতিটি University বা স্কুলে
এইগুলো পাঠ্য হোক সেই প্রচেষ্টা এখন আমাদের মধ্যে দেখা দিয়েছে।
জয়ন্ত মাহাত হরফ তৈরী করেছেন। তাঁর সাথে আপনাদের সাক্ষাৎ হয়নি।
ইন্দ্রনীল - তাঁর সাথে আমাদের সাক্ষাৎ করতে হবে।
ললিত - এই হরফের মাধ্যমে ভাষাটি প্রতিষ্ঠা পাক সেই সূত্রে আমরা চেষ্টা করে
যাচ্ছি।
সুলগ্না - এই হরফটা আপনাদের সর্বজনগ্রাহ্য ?
ললিত - এটাতো সব জায়গায় পৌঁছাতেই পারেনি। ঝাড়খণ্ডে গেছে। ওড়িশাতে
গেছে। পুরুলিয়াতে গেছে। এর আগে চেষ্টা একটা হয়েছিল। স্কুলও
চলছে। কিন্তু এটা যে বৈজ্ঞানিক পদ্ধতি অবলম্বন করে তৈরী করা হয়েছে
সেই অনুপাতে সেটা তৈরী ছিল না। তাই পুরুলিয়ার যাঁরা এই বিষয়ে
কাজ করেছেন তাঁরা এটাকেই প্রাধান্য দিয়েছেন। এই হরফটাই আমাদের
প্রযোজ্য হবে। বিহার, ওড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড, বাংলা এইসব রাজ্যে এই হরফ পৌঁছে দিয়েছি। সর্বজনগ্রাহ্য হবে কিনা সেটা পরীক্ষার মধ্যে আছে।
সুলগ্না - একজন সাহিত্যিক হিসাবে আপনি হিংসাত্মক ভাষা আন্দোলন সমর্থন
করেন ?
ললিত - হিংসাত্মক! এটা একেবারেই কাম্য নয়। তবে কুড়মালি ভাষা
আন্দোলনকারিরা কেউই হিংসাত্মক আক্রমণ করেনি। কিছু দুঃস্কৃতি ইঁট
ছুড়ে এই ভাষা আন্দোলনকে কলঙ্কিত করার চেষ্টা করেছে। কুড়মিদের
বদনাম করার অপচেষ্টা করেছে।
সুলগ্না - কুড়মি ভাষার সাথে সাঁওতালি ভাষার Ego-clash আছে।
ললিত - তেমন Ego নেই। যে যার পথে চলছে। সাঁওতালি ভাষার যেরকম
আন্দোলন হয়েছে আমরা সেই রকম আন্দোলন করতে পারিনি।
ঝাড়গ্রাম কুড়মি ক্ষত্রিয় মহাসংঘ প্রতিষ্ঠিত হল ১৯৬৫ সালে। তখন আমার কর্মক্ষমতা ছিল অনেক বেশি। তখন একদিকে স্কুলের কাজ অন্যদিকে সাহিত্য রচনার কাজ করেছি। সেই সময়ে কুড়মি ক্ষত্রিয় মহাসংঘের সম্পাদক হিসাবে নিযুক্ত ছিলাম। সেইজন্য সাংসারিক জীবন দুর্বল হয়েছিল। লেখাগুলো প্রকাশ করতে পারছি না। কিন্তু এগুলো আকর গ্রন্থ হতে পারে। ইতিহাস আগামী প্রজন্ম জানতে পারবে। গল্পের নায়কের মাধ্যমে লোধা ব্যক্তির মানসিক দিকটা আমি তুলে ধরেছি। কুড়মি ক্ষত্রিয় মহাসংঘের প্রধান ধারকবাহক তিনজন ছিলাম। ভবেশ চন্দ্র মাহাত, আমি (ললিত), হংসধ্বজ মাহাত, নিখিল মাহাত, গুণধর মাহাত আমরাই ছিলাম প্রতিষ্ঠাতা। কিন্তু পরে আমি বুঝলাম একটা ভুল হচ্ছে। কারণ টাটায় বক্তৃতা দিয়েছিলাম এবং ওড়িষ্যায় বলেছিলাম আমরা ক্ষত্রিয় নই। কারণ যারা ক্ষত্রিয় তারা করম পূজা, বান্দনা পরব করে না। ইতিহাস ঘেটে দেখি ১৯৩১ খ্রীষ্টাব্দে আমাদের সম্প্রদায়ের কিছু উচ্চশিক্ষিত ব্যক্তি নিজেদেরকে আদিবাসী থেকে ক্ষত্রিয় করার জন্য সরকারকে আবেদন করেছিল। বলেছিল পৈতা পরতে হবে। মুরগি পালন করা চলবে না। একটা ব্যর্থ চেষ্টা হয়েছিল। এখন এটা ভেঙে চুরচুর হয়ে যাচ্ছে। আমরা আদিবাসী। ভুল বুঝতে পেরে কুড়মি ক্ষত্রিয় মহাসংঘ থেকে সরে এসে আদিবাসী কুড়মি সমাজ তৈরী করলাম। আদি সংস্কৃতি সম্মেলন পুকুরিয়াতে পালন করলাম। ওড়িষ্যা, ঝাড়খণ্ড এবং পশ্চিমবঙ্গের বিভিন্ন প্রান্তের পণ্ডিতরা এসে যোগদান করেছিলেন। প্রমাণ করলাম কুড়মিরা আদিবাসী, ক্ষত্রিয় নয়। কিন্তু পরবর্তী অনুগামী তৈরী হয়নি। যুবশক্তিকে এই কাজে প্রয়োগ করার চেষ্টা করছি। সাঁওতালদের মধ্যে খুব বেশি Unity আছে যেটা কুড়মিদের নেই। তাই সাঁওতালি ভাষার প্রতিষ্ঠা সহজে হলেও আমরা এখনও পর্যন্ত লোকসভাতেই পৌঁছাতে পারিনি। কেবলমাত্র সাংসদ শুভেন্দু অধিকারী সংসদে দুটো বাক্য কুড়মালিদের নিয়ে বলেছেন। মুখ্যমন্ত্রী শিলদার জনসভাতে এই ভাষা সম্বন্ধে কিছু বলেছিলেন। জামবনিতে বলেছেন একটা কুড়মি একাডেমি তৈরী করবেন। আশা করি আমাদের ভাষার প্রচেষ্টা দ্রুতগতিতে হবে। অন্য ভাষার প্রতি আমাদের হিংসা বা বিদ্বেষ নেই। তারা তাদের পথে এগিয়ে যাবে আর আমরা আমাদের পথে এগোবো।
ইন্দ্রনীল - সত্যিই যদি একটি কুড়মি একাডেমি গড়ে উঠে তাহলে আপনারা কি চাইবেন আগামি প্রজন্ম সেখানে যাক ?
ললিত - অবশ্যই আমরা চাইব। কুড়মি ক্ষত্রিয় মহাসংঘ ১৯৬৫ সালে তৈরী হওয়ার পর অনেক মানুষ এর সঙ্গে ছিল। কিন্তু ধীরে ধীরে মানুষ এখান থেকে সরে যায়। আমি নিজেই সরে যাই। দেখা যাচ্ছে যাদের এখন ৭৫ বছর বয়স অর্থাৎ যারা প্রথমে শুরু করেছিল শুধু তারাই আছে। তাদের অনুগামী বলে এখন কেউ নেই। কুড়মিদের যুবশক্তিকে প্রেরণা দিতে হবে। আমরা এই ভাষার গ্রামার বই লিখেছি। ভাষা সংস্কৃতি বাঁচাবার নানা ধরনের পন্থা অবলম্বন করা হয়েছে। মুখ্যমন্ত্রীকে সব কিছুই জানানো হয়েছে। পরে আরো পাঠানো হবে।
ইন্দ্রনীল - আপনারা টেক্সট বই তৈরী করেছেন ?
ললিত - টেক্সট বই তৈরী করা হয়েছে। ছোট ছোট বই প্রকাশিত হয়েছে।
ইন্দ্রনীল - প্রাথমিক স্তরে আপনারা মাতৃভাষা শিক্ষার উদ্যোগ গ্রহণ করেছেন।
ললিত - হ্যাঁ, প্রাইমারিতে মাতৃভাষা শিক্ষার উপর জোর দেওয়া হচ্ছে। আশা করছি যুবশক্তিকে আকর্ষণ করতে পারব। ইতিমধ্যে অনুগামীও তৈরী হচ্ছে। আমাদের উদ্যোগের একটা সুফল আসছে। আমি আশা করছি আমরা অবশ্যই সফল হব।