করম বা কারাম রাজার কর্মযজ্ঞকে করম কাহিনী বা কারাম বিনতী বলে। উচ্চারণ ও শব্দের ছন্দবদ্ধ শ্রুতি মধুর অনুভব প্রকাশ করার অর্থে করম বা কারাম ঠাকুর। তপস্যায়, ধ্যানে বা কর্মপ্রচেষ্টায় যে কৃতকর্মের ফল পাওয়া যায় এমন নিষ্ঠা দেশজ মানুষের নির্ণায়ক শক্তিই করম ঠাকুর। প্রকৃতিবাদী পূজকরাই করম মাসে করম ঠাকুর বা করম রাজার পূজা করেন। করম ঠাকুর যে পরিবারে লীলা দেখান বা ছলনা করেন তখন সেই পরিবার বুঝে নেন ঠাকুর দর্শন দিচ্ছেন, তাঁকে স্মরণ করতে হবে পূজার আয়োজন করতে হবে। আদি ধর্মানুসারেই করম পূজা হয়। করম বা কারাম ঠাকুরের প্রতীক কারাম দারু (প্রচলিত আঞ্চলিক গুঁড়ি কদম গাছ)। এক সময় মানুষ যখন প্রকৃতির কাছে একেবারে অসহায় তখন মানুষ জীবন রহস্যে বেঁচে থাকার তাগিদে সুখ ও শান্তির সহায়ক শক্তিকে প্রার্থনা করত। প্রকৃতিবাদী দেশজ মানুষেরা তাই স্রষ্টার সৃষ্টিকে জীবনশক্তির উপাদান হিসাবে পূজা করে আসছেন। মানুষের যখন জীবন ছন্দের ব্যাঘাত ঘটেছে তখন কোনো না কোনো শক্তির আরাধনা করেছেন। যেমন প্রাকৃতিক দুর্যোগ, প্রাণীকুল ধ্বংস, মনুষ্যকুলের জীবন অসহায় ও বিকাশের অন্তরায়। প্রকৃতি, জীব ও বিশ্বব্রহ্মাণ্ড এই সৃষ্টিকে মানবকুল অনুধাবন করে অসহায়ের মধ্য দিয়ে যেটুকু আনন্দের পসরা মেলে ধরতে পেরেছে তাদের সেই জীবন দর্শন কালের শ্রুতির মাধ্যমে স্রষ্টার সৃষ্টি কৌশল জানার চেষ্টা করেছে। করম পূজার আয়োজন ভাদ্র বা আশ্বিনে পার্শ্ব একাদশী তিথিতে। করম পূজা হয় প্রথমত পরিবারের বংশভিত্তিক, বংশের একটি পরিবারে পরপর তিন বছর পূজো হলে পরের বছর বংশের আর একটি পরিবারের কাছে ঠাকুরকে সঁপে দেওয়া হয়। যে পরিবারে করম ঠাকুরের পূজোর আয়োজন করা হয়, সেই পরিবারের নিকটস্থ আত্মীয়বর্গ, পরিবারের কর্তার বংশসকল মামাকুল, পেসা-পিসীসকল। পরিবারের কর্তার শ্বশুরের পরিবার ও মামাশ্বশুর ও নিজ মামাকুল। বিশেষভাবে যত্ন ও নিষ্ঠার সহিত পরিবার কর্তার পরিবার কর্তার নিজ কন্যা ও জামাতা নিমন্ত্রিত হন। জামাতা করম ঠাকুরকে শ্বশুর বাড়ীতে নিষ্ঠার সঙ্গে যাতে পৌঁছায় তার সমস্ত আয়োজন নিজেই দেখাশুনা করেন ও ঠাকুরের ডাল টাঙ্গি দিয়ে এক কোপে দ্বি-খণ্ডিত করে ডালকে জাওয়া কন্যা তিনজনকে ধরিয়ে দেওয়া হয়। গিতিল হাউর (বালি সংগ্রহ), জাওয়া জাগাও, ডালিতে সংগৃহীত বালির মধ্যে শস্য বপন বীজসমূহকে গান গেয়ে গেয়ে জাগানো হয়। বয়স্ক-বয়স্কা, আবাল-বৃদ্ধ-বনিতা গ্রামের সকলকেই নিমন্ত্রণ করা থাকে। পর পর তিনদিন করম ঠাকুর যে বাড়ীতে পূজিত হন, সেই বাড়ীতে গ্রামবাসীগণের সকল রকমের সাহায্য সহযোগিতায় সব মিলিয়ে মহাউৎসবে পরিণত হয়। পরের দিন করম ঠাকুরকে ভাসান দিয়ে আবার এক-দুই ঘণ্টা কুটুম-বন্ধু, গ্রামবাসী সকলে বিদায় নাচ ও গান গেয়ে আখড়া মেটানো পর্ব সাঙ্গ করে বিদায় নেন।
দ্বিতীয়তঃ করম ঠাকুরের মাহাত্ম্য মেনে গ্রামের (করম ঠাকুরের) ভক্তপ্রাণ ব্যক্তি, ক্লাব, সংঘ হাউসী সকল, দেশুয়া কারাম বাডাঙ্গুয়া কারাম গড়ার বা পূজার আয়োজন করেন। পরিবারভিত্তিক যে পূজার নিয়ম থাকে বা নিমন্ত্রণ থাকে দেশুয়া বাডাঙ্গুয়া কারাম পূজোয় সেরকম আত্মীয় কুটুম বন্ধুর আমন্ত্রণ নিমন্ত্রণ থাকে না বললেই চলে।
করম ঠাকুরের পূজো একই রাত্রিতে পার্শ্ব একাদশী তিথিতে যখন পূজা হয় নৃত্য রসিক বা হাউসীদল সারারাত্রি ব্যাপী একাধিক পূজামণ্ডপে এক আখড়া নাচ ও গান ঠাকুরের মাহাত্ম্যের উদ্দেশ্যে উৎসর্গ করে নিজেকে ধন্য মনে করেন।
করম ঠাকুরের বামা যারা জানেন তারা কোথাও কোনো পূজামণ্ডপে নাচতে গান গাইতে ও মাদল ধমসা বাজাতে বাদ দেন না। ভাদ্র মাসের নিঝুম বৃষ্টি ও জ্যোৎস্না রাত্রে হাঁটু ভর্তি কাদা খামামে ভক্ত রসিক ও গোপীনীগণই কেবল তাঁর মাহাত্ম্য অনুভব করেন। ঠাকুরের কাছে কী না পাওয়া যায়। গোপীনীগণ তাই ব্রত করে সকাল থেকেই অপেক্ষা করেন ঠাকুরের পাতা ছুঁয়ে বর, ঘর, সন্তান, সুখ, শান্তি, ধন, দৌলত পাওয়ার বাসনায় সেই পূজার ক্ষণ অপেক্ষা করে থাকেন।
করম ঠাকুরকে বরণ -
পরিবারের কর্তা করম ঠাকুরকে নিমন্ত্রণের আয়োজন করে শ্রাবণ মাসে রাখি পূর্ণিমা বা গমা পূর্ণিমাতে। নতুন সুতা হলুদ মাখিয়ে কারাম দারু দাড়া (গুঁড়ি কদম গাছের ডাল) বন্ধন করে বরণ করে নেওয়া হয়। যাতে করে ঐ গাছে আর কেউ যেন আমন্ত্রণ না করে। একে আঞ্চলিক ভাষাতে ‘ছুতি’ বলা হয়ে থাকে। দেশুয়া বা ডাঙ্গুআ কারাম পরিবারের মতো ততটা ঘটা করে পূজা হয় না। তেল সিঁন্দুর করম ডাল একটি বাঁশের চারফালি শালুক ফুল দিয়ে শোভামণ্ডিত করা হয়। কিন্তু পার্শ্ব একাদশী তিথিতে এ পূজো হয় না। ভাদ্র-আশ্বিন মাসের যে কোনো শনি বা মঙ্গলবার দেশুয়া কারাম বা ডাঙ্গুআ কারাম পূজো করা হয়। ভক্তিপ্রাণ করম ঠাকুরের সেবকগণ সাংস্কৃতিক স্বাভিমান ও জীবন রহস্যের অনুভূতি সংঘবদ্ধভাবে ভাষায় আকার ও ইঙ্গিতে বা অঙ্গভঙ্গির ছন্দময় প্রকাশ এই মণ্ডপগুলিতে লক্ষ্য করা যায়।
যে পরিবারে করম ঠাকুর আবির্ভূত হয়েছেন সেই পরিবারের উঠান, ঘর-দুয়ার পনের দিন আগে থেকে পরিষ্কার পরিচ্ছন্ন, দেওয়াল সাদা মাটি দিয়ে লাতা-পুতা ও বিনা রং-এ নানা রকমের আলপনা দেওয়ালে আঁকা থাকে। গ্রামের তিনজন বালিকা কন্যা করম ঠাকুরের সেবিকা হিসাবে তিন দিন ‘জাওআ’-র পরিচর্যা করে। যে ঘরে ‘জাওআ’ রাখা হয় কুমারী কন্যা তিনজন জাওআ ডালিতে ভেজা বালিতে রবিশস্য বীজের অঙ্কুরোদগমের অবস্থা পরিচর্যা ও পর্যবেক্ষণ করে থাকে, অত্যন্ত পবিত্র মনে শুচি বস্ত্রে ও নিষ্ঠা সহকারে।
পরবর্তীকালে কন্যারা যখন নারীত্ব লাভ করেন মাতৃত্বকালীন সময়ে ভ্রুণত্ব শিশুর পরিচর্যা এমন নিয়ম নীতি নিষ্ঠা সহকারে যত্ন নেন। প্রকৃতির পুষ্টি ফলের মত তাদের সন্তান সন্ততিরাও হয় শৌর্য বীর্যের প্রতীক।
প্রথম দিন - গৃহকর্ত্রী পুত্রবধূসহ আত্মীয় গ্রামবাসিগণ নদী থেকে বালি সংগ্রহ করে আনেন। প্রাক কৈশোর তিন কন্যা অনুর্দ্ধ আট বৎসর এমন কন্যা ব্রত উপবাসী থাকে। গান বাজনা সহকারে নদী থেকে বালি সংগ্রহ করে আনা হয় বিকালবেলা এবং ডালিতে রবি শস্য যথা- বিরী, মুগ, যব, সনবীজ তিন কন্যা মিশ্রণ করে ডালিতে তুলে দেয়। ঐ কন্যাদের তিনটি পুড়া থাকে (আপিয়াপুড়ুঃ) শাল পাতার ঐ পুড়াতে তিন কন্যার দু’রকমের পদ্ধতিতে শস্য মিশ্রণ করে পুড়াতে তোলে। প্রথম জন সোজা হাত দিয়ে, পুড়াতে সংগ্রহ করলে, ভাত খাওয়ার সময় হাত উল্টে ভাত খেতে হবে। দ্বিতীয় জন উল্টো হাতে শস্য মিশ্রণ পুড়াতে তুললে সে সোজা হাতে ভাত খাবে। তৃতীয় জন প্রথম জনের মত সোজা পুড়াতে তুললে ভাত খাওয়ার সময় হাত উল্টে ভাত খাবে। প্রথম দিনে বালি সংগ্রহ জাওআ মিশ্রণ ডালিতে ও পুড়ায় সংগৃহীত হয়ে ধূপধুনা গান বাজনা দিয়ে ঘরের কোণে রেখে দেওয়া হয়।
দ্বিতীয় দিন - গ্রামের সকলকে ডেকে দেওয়া হয়। সন্ধ্যাবেলা সকলে সমবেত হলে পরিচর্যাকারী তিন কন্যা ও পরিবারের গৃহবধূ ঘরের ভেতর থেকে ডালি বের করে খামারে গোবর দিয়ে পরিষ্কার করা জায়গায় চালগুঁড়ির আলপনা (মাডওআ) আঁকা স্থানে চারপা মাঞ্চির উপর ডালি এবং কাঠের পিঁডার উপর পুড়া তিনটি রাখা হয়। মণ্ডপে চারিদিকে দফায় দফায় তিনবার ঘুরানো হয় এবং দীর্ঘক্ষণ ধরে করম ঠাকুরের জাওআ জাগানো গান উপস্থিত সকল মহিলারা সমবেত কণ্ঠে ঘণ্টা তিনেক গান করেন। পূজা অর্চনা শেষ হলে তিন কন্যা ও গৃহবধূ ডালিটিকে ঘরের ভেতর দুবার ঢুকিয়ে বের করে আনে, তৃতীয় বারে আগে যেখানে ছিল পুনরায় সেই জায়গাতে রেখে দেওয়া হয়। অতঃপর দ্বিতীয় দিনের জাওআ জাগানো এইভাবে শেষ হয়।
তৃতীয় দিন - এদিন একে একে কুটুম বন্ধু বাকীরা সবাই এসে যান। পুরা গ্রামে পরিবার কর্তা পুনরায় নিয়ম ডাক দুপুরেই ডেকে দেন। সন্ধ্যা হতে হতেই গ্রামের মা-বোন সকলেই হাজির হয়ে যান। খামারে করম ঠাকুরকে বসানোর মণ্ডপ তৈরী করা হয়। বাঁশকে চিরে বাতা তৈরী করে বাঁকিয়ে বাতার শেষ প্রান্ত দুটি এমন করে চার খণ্ড বাতার মণ্ডপের চার দিকে চার অংশে বাঁকিয়ে মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয় এবং বেদীর চারদিকে আলপনা (মাডওআ) আঁকা হয়। বাঁকানো বাঁশের বাতাগুলোতে শালুক ফুলের কাণ্ড ভেঙ্গে ভেঙ্গে মালার মতো করে সাজানো হয়। বেদীর সন্নিকটে আট-দশ ইঞ্চি গোলাই পঞ্চাশ-ষাট ফুট বাঁশ আট-দশ ফুট গোড়ার দিকে রেখে অগ্রভাগ থেকে ফালি করে চার ভাগে ভাগ করা হয়। বাঁশের গোড়ার দিকে দেড় ফুট মাটিতে গর্ত করে অগ্রভাগের চার অংশ বাঁকিয়ে বাতাগুলি চারদিকে চারটি খুঁটিতে বেঁধে দিয়ে শালুক ফুলের মালা দিয়ে সাজানো হয়। পূজোমণ্ডপ সাজানোর কাজগুলি দিনের বেলা সমাপন করা হয়। বিকেলবেলা গোপিনীগণ ও অতিথি সকল পরিবারের ব্রতী মহিলারা ও হাউসী রসিকগণ মাদল ধমসা পূজোর নৈবেদ্যসহ রাখি পূর্ণিমাতে নিমন্ত্রণ করে আসা করম ঠাকুরকে ঘরে আনার জন্য সমবেত হন। ঘরের বধূরা পূজোর নৈবেদ্য নিয়ে সারি সারি গোপিনী ও ভক্ত সেবকগণসহ রওনা হন। নির্দিষ্ট করা জায়গায় পৌঁছে করম ঠাকুর (কদম গাছ) -কে গৃহকর্তা ঘটির তুলসী জল গাছের ডালপালায় ছিটিয়ে গাছের নীচে সিঁন্দুর ঘটে ডান হাতের মধ্যমা আঙ্গুলে মাটিতে ধরিত্রী মাতার উদ্দেশ্যে তিন বার করে তিন দফা মাটিতে সিঁন্দুরের টিক দেন। এরপর বসুমাতা ও গাছকে উদ্দেশ্য করে বাড়ীর সকলে প্রণাম করে বাড়ীর জামাতা টাঙ্গি দিয়ে এক কোপে দ্বিখণ্ডিত করে জাওয়া কন্যাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়। বাকী দুটি ডাল কেটে পরের দুটি কন্যাকে ধরিয়ে দেওয়া হয়। সঙ্গে মাদল-ধমসা-শঙ্খ বেজে ওঠে, এবং করম ঠাকুরের উদ্দেশ্যে গান গেয়ে ঘরে আসতে প্রায় সন্ধে হয়ে যায়। বাড়ীতে এসে গৃহবধূ বাড়ী থাকা ‘জাওআ’ বের করে পূজোর জায়গায় রাখে এবং তারই পাশে করম ঠাকুরকে মাটিতে বসানো হয়। সন্ধ্যে হওয়ার সাথে সাথে উপবাসী মহিলারা, মেয়েরা নতুন বস্ত্র পরে থালায় পূজার নৈবেদ্য যথা - শশা, চিড়া, চালভাজা, লসদবা সাজিয়ে নিয়ে মণ্ডপের চারিদিকে একটি মাত্র খড়ের উপর আসন মান্যতা দিয়ে বসেন। গোপিনীগণের মণ্ডপে আসার সঙ্গে সঙ্গেই করম ঠাকুরকে ঘর থেকে বাহিরের মণ্ডপে আনা হয়। উল্লেখ থাকে যে, যতবার করম ঠাকুরকে তিনদিন ব্যাপী বাহির-ভিতর করা হয় ততবার দরজার ছাঁচাতলে দুজনকে কাপড় উপরে ছাতার আচ্ছাদন করে রাখতে হয়। মণ্ডপের কাছে দুটি বড় গর্ত করা হয়ে থাকে। একটিতে দুধ ঢালা হয় ও আরেকটিতে জল ঢালা হয় পূজোর ক্ষণে ক্ষণে। খাটিয়ার মত একটি মাঞ্চি শস্য মিশ্রিত ডালি মণ্ডপে মঞ্চির উপরে রাখা হয়। কাঠের পিঁড়ার উপর প্রাক কৈশোর কন্যাদের মিশ্রিত অঙ্কুরোদগম শস্য পুড়া (শাল পাতার ঠোঁঙা) কাঠের উপর সারিতে সাজানো হয়। পূজামণ্ডপের অবস্থান সর্বদা পূজারী পূর্ব মুখে বসে পূজা করেন। পূজার সময় ক্ষণে ক্ষণে দুধ ও জল আলাদা আলাদা গর্তে ঢালা হয়।
মাঞ্চি ও ডালি (অঙ্কুরোদগম) গৃহকর্তা, গৃহবধূ ও অপর কেউ একজন অর্থাৎ মোট তিনজন মিলে দুবার ভিতর বাহির করার পর তিন বারের সময় মণ্ডপে সযত্নে রাখা হয়। সুতা বাঁধা করম ডালটিকে মণ্ডপের মাঝখানে এবং বাকী দুটি ছোট ডালকে ঐ সুতাবাঁধা ডালের কাছাকাছি মাটিতে পুঁতে দেওয়া হয়।
সাজ-সাজ পূজামণ্ডপ আত্মীয়স্বজন গ্রামবাসী সকলেই উঠান ভর্তি গোপিনী সকল পূজামণ্ডপের চারিদিকে পরিবেষ্টিত হয়ে বসে থাকেন। গৃহকর্তা ও গৃহকর্ত্রী পূজামণ্ডপের সম্মুখে বসে, মাটির তৈরী ঘোড়া ও কুমীর বা শশাকে কুমীর মত করে নেওয়া অথবা শশাকে চারটি কাঠি দিয়ে ঘোড়া করা। এরকম জীবের আকৃতি ধরে নিয়ে ব্রত উপবাসী গোপিনী সকলের থালিতে কুমীর ও ঘোড়ার সাজে থাকে।
করম ঠাকুরের মাহাত্ম্য যিনি ব্যাখ্যা দেন তিনি পনের দিন আগে থেকে অর্থাৎ করম ঠাকুরের নিমন্ত্রণের সঙ্গে সঙ্গে করম ঠাকুরের ব্যাখ্যাকারী বা করম বিনতীকার সসম্মানের সহিত নিমন্ত্রিত হন। তিনি পূজোর দিনে পূজোর ক্ষণে গৃহকর্তার বাড়ীতে উপস্থিত হন সঙ্গে একজন ‘হ্যাঁ’ বলার সঙ্গীকে সঙ্গে নিয়ে এবং গৃহকর্তা তাদের দুজনের জন্যও নতুন ধুতি ও গেঞ্জি উপহার দেন। এরপর পূজোর সময় ব্যাখ্যাকারী ওই নতুন ধুতি ও গেঞ্জি পরে পূজোমণ্ডপে পূর্বমুখীর ডানদিকে বসে করম ঠাকুরের মাহাত্ম্য ব্যাখ্যা করতে শুরু করেন।
আসুন তাহলে আমি লেখক ও পাঠকগণ, গৃহকর্তা, সমবেত শ্রোতা ভক্তপ্রাণ গোপিনী সকলে মিলে এখন আমরা শুনব করম ঠাকুরের আবির্ভাবের নেপথ্যের কাহিনী যাকে ‘কারাম কাহিনী’ বলে। যিনি ব্যাখ্যা দিচ্ছেন তাকে আমরা বিনতীকার বলব।
বিনতীকার - নম নম ব্রহ্মাণ্ড সৃষ্টিকারী কর্তা, নম তোমার ইচ্ছা, নম তোমার সৃষ্টি লীলা। হে ঠাকুর, তোমার দয়াই মোদের জীবন, তোমার স্নেহই মোদের প্রাণ। আজি ভক্তগণের সবার লহগো প্রণাম। এই বিশ্বব্রহ্মাণ্ড ঠাকুর যখন সৃষ্টি করেন তখন ঠাকুরানীর খুব ইচ্ছা হল ঠাকুরের সৃষ্ট ব্রহ্মাণ্ড দেখার। তাই স্বর্গ হতে নীচে তাকাতেই ঠাকুরানীর চোখে পড়ল গোলাকৃত সোনালী উজ্জ্বল গোলাকৃতি জলমণ্ডল। ঠাকুরাণীর চোখে এমন দৃশ্য দেখে ঠাকুরকে বললেন, ঠাকুর চল না ঐ দেখ, কেমন সুন্দর চকচকে সোনালী দেখা যাচ্ছে। যাই চলো না একবার। ঠাকুর ঠাকুরাণীর জেদ দেখে না বলতে পারলেন না, ঘাড় নেড়ে ঠাকুরাণীর ইচ্ছায় শরীর পরিবর্তন করে হংস-হংসী রূপ ধারণ করে স্বর্গ হতে উড়তে উড়তে নেমে এলেন দিগন্ত ব্যাপৃত জলরাশির উপর। চারিদিক উড়ে বেড়ানোর পর ও কোথাও কোন স্থলভূমির স্থল দেখতে পেলেন না। তাই হংস-হংসী রূপিনী (ঠাকুর-ঠাকুরাণী) কথোপকথন হয়ে জলের মধ্যেই সাঁতরে বেড়াতে লাগলেন। ঠাকুরাণী বললেন হতাশ হয়ে — সেকি! এতদিন আমরা সাঁতরে বেড়ালাম কোথাও কোনো প্রাণের সন্ধানতো পেলাম না। ঠাকুর বললেন — তাইতো! ঠাকুরাণী বললেন, আমি ডাক দিয়ে দেখি, কেউ যদি ডাকে সাড়া দিয়ে আসে।
‘এ — কে আছ, আমার ডাক কি কেউ শুনতে পাচ্ছ।’ এমন হাঁক ডাক শুনে জলের রাজশ্বরেরা বিভিন্ন প্রান্ত থেকে এসে ঠাকুর ও ঠাকুরাণীর কাছে জড়ো হলেন। এমন ধরনের ডাকতো জলরাশির মধ্যে কোনোদিন এঁরা শোনেন নি। এমন ধবধবে সাদা হংস-হংসীকে দেখে ভক্তিতে নতমস্তক হল। জলের রাজা বিশালাকার চেহারা জলরাশির একেক প্রান্তের একেক জন রাজা। প্রথম জন এল বিশালাকার মাছ, নাম তার রাঘব বোয়াল। দ্বিতীয় জন হল বিশাল কুমীর, তৃতীয় জন হল বিশাল কচ্ছপ যাকে দেখলে একটি দেশের মতো দেখতে লাগে। চতুর্থ জন বিশালাকার কাঁকড়া। যে জলের নীচের অংশে রাজত্ব করে। পঞ্চম জন হচ্ছে বিশালাকার পাইপের মতো কেঁচো। সবাই একে একে প্রণাম জানিয়ে তাদের ডাকার কারণ জানতে চাইলেন। ঠাকুরাণী প্রাণীকুলকে আশীর্বাদ জানিয়ে ঠাকুর ও ঠাকুরাণী বললেন যে তারা স্বর্গরাজ্য থেকে এসেছেন এবং তারা ঐ রাজ্যের অধিকারী। এমন একটি মনোহর জলাশয়ে কোথাও কি কোন মাটির সন্ধান আছে। এমন প্রশ্নের উত্তরে সবাই এক বাক্যে বলল — হ্যাঁ, আছে। তবে জলের নীচে। ঠাকুরাণী বললেন তোমরা কেউ মাটি আনতে পারলে আমি অর্ধেক রাজ্য ও কন্যা সম্প্রদান করব।
এমন শর্তে কে না রাজী হয় ? ওদের কাছে মাটি আনাটা কোনো ব্যাপার নয় ধরে নিয়ে বিশালাকার মাছ ‘রাঘব বোয়াল’ বলল — তার নাম রাঘব বোয়াল। সে তার বিশালাকার পুচ্ছ ও মাথা নাড়িয়ে ঠাকুরাণীকে তার বিশালাকার মুখ টাপসে সংকেতে ইঙ্গিত দিল যে, সে আগে যাবে এবং তার বিশালাকার মুখ জলে ডুবিয়ে অনায়াসে জলের নীচ থেকে মাটি আনতে পারবে। ঠাকুরাণী তাকে হুকুম দিলেন মাটি আনার জন্য। রাঘব বোয়াল তৎক্ষণাৎ জলের তলদেশে গমন করে এবং মাটি কামড়ে উঠে আসতে তার এক-দু দিন লেগে গেল। মাটি কামড়ে যখন উঠে আসে ঠাকুরাণীর কাছে তখন রাঘব বোয়াল মাছের মুখে যৎসামান্য মাটি পর্যন্ত নেই। ঠাকুরাণীর কাছে অনুতাপ স্বরে রাঘব বোয়াল বলল, ঠাকুরাণী দেশের ন্যায় মাটি নিয়ে আসতে ছিলাম জলের মধ্যে সব মাটি ধুয়ে গেল।
এরপর দ্বিতীয় জন কুমীর বলল — ঠাকুরাণী আপনি যদি আমাকে হুকুম দেন, তবে আমার এই বৃহদাকার মুখ দিয়ে মাটি এনে আমি স্থল বানিয়ে দেব। ঠাকুরাণী বললেন — ‘যাও তবে’। কুমীরও প্রায় দুদিন অতিবাহিত করার পর উপরে যখন মাটি নিয়ে আসে, তখন কুমীরের মুখে মাটির কোনো লেশ নেই। ঠাকুরাণীর কাছে পৌঁছাতেই কুমীরের মুখ থেকে জলে সমস্ত মাটি ধুয়ে গেছে। এরপর বৃহদাকার কাঁকড়া ঠাকুরাণীর কাছে মাটি আনার প্রস্তাব দেন যে সে জলের নীচে অনেক বড় বড় গর্ত করে পাহাড় বানিয়েছে এই দশ ঠ্যাঙের দ্বারা। কাঁকড়া বলল, ‘‘আমি নিশ্চিত পারব আমার এই দশ ঠ্যাঙের দ্বারা মাটি নিয়ে আসতে।’’ পরিশেষে জানা যায় কাঁকড়াও মাটি আঁকড়ে আনতে গিয়ে সকল মাটি জলে ধুয়ে গেছে। ঠাকুরাণীর কাছে গিয়ে মাটি আনার অক্ষমতা স্বীকার করে। এরপর কচ্ছপ ঠাকুরাণীর কাছে গিয়ে বলল — আজ্ঞে ঠাকুরাণী, আমাকে হুকুম দিন। আমি জলের তলদেশে গিয়ে আমার পিঠের সাহায্যে অজস্র মাটি বয়ে নিয়ে আসব। ঠাকুরাণী তার কথাতেও মত দিলেন। কচ্ছপ জলের তলদেশে গমন করল এবং জলের তলদেশ থেকে পাঁকের কাদাতে ডুবে মাটি আনতে আনতে প্রায় দুদিন লেগে গেল। মাটি বয়ে যখন ঠাকুরাণীর কাছে পৌঁছায় তখন কচ্ছপের পিঠে একমুঠো পর্যন্ত মাটি নেই। কচ্ছপ খুব হতাশ হয়ে ঠাকুরাণীর কাছে অন্যান্যদের মতো বলল, ঠাকুরাণী, জলের মধ্যে আসতে আসতে আমার পিঠের সমস্ত মাটি জলে ধুয়ে গেল। এরপর কেঁচো এঁকে বেঁকে এসে ঠাকুরাণীকে বলল, ‘‘ঠাকুরাণী আমায় হুকুম দিন, আমি কেবল মাটি আনব না, জলের উপরিভাগে যদি কেউ আমাকে সাহায্য করে তবে আমি জলের উপরি অংশে মাটির বিশাল অংশের দেশ বানিয়ে দেব।’’ ঠাকুর-ঠাকুরাণী কেঁচোকে দেখে পরস্পর পরস্পরের দিকে তাকালো এবং উভয়েই কেঁচোর কথা ভাবলো। ঠাকুরাণী ভেবে বললেন, আর কেউতো পারে নি, তুমি কিভাবে মাটি নিয়ে আসবে ? কেঁচো বলল, ‘‘আমার এই বৃহদাকার পাইপের মত শরীর বিস্তৃত করতে করতে জলের তলে আমার মুখখানি দিয়ে মাটি গিলে উদরের মধ্য দিয়ে পায়ুছিদ্র দিয়ে মাটি উপরে তুলে নিয়ে আসব। তবে মাটি ধরে রাখার জন্য কারো সাহায্য নিতে হবে।’’ এমন কথা ঠাকুর-ঠাকুরাণীর মনে ভীষণ দাগ কাটল। তাঁরা সময়ে ভাবল পদ্ম পাতার উপরে যদি মাটি রাখা হয় কেমন হয় ? পরে আরও ভেবে ঠাকুরাণী কচ্ছপকে অনুরোধ করে, কচ্ছপ জলদেশের উপরি অংশে স্থির থেকো, কেঁচো তোমার পিঠে মাটি জড়ো করবে। কচ্ছপ বলল, ঠাকুরাণী আমি যদি স্থির থাকি, তাহলে কি খেয়ে বেঁচে থাকব ? ঠাকুরাণী বললেন — সৃষ্টি সার্থক হলে মানব অন্নগ্রহণের আগে তুমি চিরদিন অন্ন পাবে। এই কথা শোনার পর কচ্ছপ স্থির হয়ে থাকল, আর কেঁচো জলের নিম্নদেশে গিয়ে মাটি মুখে গ্রহণ করে উদরের মধ্য দিয়ে পায়ুছিদ্রের মধ্য দিয়ে কচ্ছপের পিঠে মাটি পাঠাতে শুরু করে। এইভাবে মাটি ক্রমশ পাঠাতে পাঠাতে ক্রমে অনেক বড় থলথলে মাটির স্থলভূমি তৈরী হল। কেঁচো এবারে ঠাকুরাণীর কাছে তাঁর প্রতিশ্রুতি রাখার কথা স্মরণ করালো অর্ধরাজ্য ও কন্যা সম্প্রদান করার।
ঠাকুরাণী কার্ত্তিক মাসে কন্যা সম্প্রদান করবেন বলে কেঁচোকে কথা দিলেন। তাইতো কেঁচোর বংশধরেরা আজ অবধি কার্ত্তিক মাসে বিবাহের জন্য কন্যা খুঁজতে পথে-ঘাটে-মাঠে সর্বত্র প্রতিশ্রুতি আদায়ের জন্য বেরিয়ে পড়ে। পথ ঘাট সর্বত্র তখন শুকনো ধূলা-বালিতে কেঁচোদের পক্ষে পথ চলা খুবই মুসকিল। কেননা গোটা শরীর ধূলো-বালিতে মাখামাখি কেঁচোর পক্ষে পথ চলা সম্ভব নয়। ঠাকুরানীর কাছে যাওয়া যেমন সম্ভব নয় তেমনি বিবাহ করাও অসম্ভব হয়ে পড়ল।
স্থলভাগ তৈরী হল কচ্ছপের পিঠের উপর। কচ্ছপ যখন একটু নড়াচড়া করে তখন যেন স্থলভাগ কম্পন হয়ে ওঠে। ঠাকুর ও ঠাকুরাণী দেখল সত্যই স্থলভাগ তৈরী হল। তিনভাগ জল ও একভাগ স্থল। থলথলে ভূভাগ কি করে শক্ত করা যায় ঠাকুরকে ভাবতে বললেন। ঠাকুর বারে বারে হাত দিয়ে থলথলে কাদা অংশগুলি ঘাঁটাঘাঁটি করতে সচেষ্ট হলেন। ঠাকুরের শরীরের যে লোমগুলি থলথলে কাদায় পড়ল সেই লোমের অংশ থেকে দূর্বা ঘাস নামক ঘাস মাটিতে প্রথম জাত হল যা কিনা এখন ঘাস মাটিকে ধরে রাখতে সাহায্য করে এবং মানব জাতির পবিত্র কাজে লাগে। এইভাবে মাটি শক্ত হতে হতে ক্রমে স্থলভাগে ঘাস-লতা, গাছ-গাছালি জঙ্গল এবং স্থলভাগ ক্রমে ঠাকুর ঠাকুরাণীর কাছে অতি প্রিয় স্থান হয়ে উঠল।
ঠাকুরাণীর স্থলভূমি থেকে স্বর্গে যাওয়ার আর ইচ্ছে হচ্ছে না। ঠাকুরাণীর ইচ্ছা হল মাটিতে খেলা, মাটি দিয়ে খেলতে খেলতে পুতুল তৈরী করলেন, পুতুল ছেলে ও পুতুল মেয়ে বানালেন। ঠাকুর পুতুল পুতলীকে শক্ত করার জন্য আগুনে তাপ দিয়ে শক্ত করলেন। ঠাকুরাণী বললেন এখন ওদেরকে জীবন দাও। ঠাকুর ভাবলেন এই শক্ত মাটিতে জীবন দিলে এরা যদি অমর হয়ে যায় তাহলে এই তিনভাগ জল একভাগ স্থলে এদের জায়গা অকুলান হবে এবং ওদের মধ্যে ভয়ঙ্কর সংঘর্ষ হবে। এই আশঙ্কার কথা ঠাকুরাণীকে বললেন। ঠাকুরাণী সত্যই খুব চিন্তিত হয়ে পড়লেন। উভয়েই খুবই চিন্তামগ্ন হলেন। ঠাকুরাণী চিন্তামগ্ন অবস্থায় ঘর্মাক্ত হলেন এবং শরীর থেকে ঘাম মুছতে গিয়ে হাতের তালুতে ময়লা জমে গেল। সেই ময়লা দিয়েই ঠাকুরাণী পুতুল পুত্র ও পুতুল কন্যা বানিয়ে ঠাকুরকে শক্ত করার কথা বলতেই ঠাকুর আগের মতো আগুনের তাপ দিতেই পুতুল দুটি আগুনে পুড়ে ভস্মীভূত হল। তখন ঠাকুর ঠাকুরাণীকে গায়ের ময়লা দিয়ে আবার দুটি পুতুল তৈরী করতে বললেন এবং ঠাকুরের কথা মতো ঠাকুরাণী আবারও দুটি পুতুল বানালেন এবং ঠাকুর ঐ মানব মানবীর জীবন দান করলে সেই মানব মানবীর নাম হল পুইতু হাড়াম এবং পুইতু বুড়ী।
ঠাকুর ও ঠাকুরাণী এর ওর সঙ্গে সহযোগিতা করে যে স্থলদেশ বা মিরতিকা (মির + টিকা) সর্বশ্রেষ্ঠ বা ধারতী ধার করে (ধার + তী) সৃষ্টি সম্পদ তৈরী হয়েছে, তাই ধারতী (ধরিত্রী)। ঠাকুর ঠাকুরানীর ইচ্ছা পূরণ হল। এখন পুইতু হাড়াম ও পুইতু বুড়ীকে ভূভাগে ছেড়ে দিয়ে ঠাকুর ঠাকুরানী স্বর্গে ফিরে গেলেন। এরাই প্রথম নরনারী, তাদের নাম হল পুইতু হাড়াম, পুইতু বুড়ী।
(আগামী সংখ্যায় সমাপ্য)