পৃথিবী বক্ষে মানবকুল অভ্যন্তর নারী ও পুরুষের মধ্যে উভয়কে জীবন সঙ্গী ও সঙ্গিনী রূপে সামাজিক স্বীকৃতি প্রদানই হলো বিবাহ। মানবকুল অভ্যন্তর আবার বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠী তাদের স্ব-স্ব বৈশিষ্ট্য নিয়ে পৃথিবী বক্ষে অবস্থান করছে। স্বীয় বৈশিষ্ট্য সহকারে অবস্থানরত এক-একটি জাতি বা সম্প্রদায় অভ্যন্তর আলাদা আলাদা রূপে তথা পদ্ধিত বা প্রথায় নারী ও পুরুষের জীবন সঙ্গী ও জীবন সঙ্গিনী রূপে সামাজিক স্বীকৃতির ক্ষেত্র প্রস্তুত করা হয়ে থাকে, যাকে বিবাহ বলা হয়। বিভিন্ন জাতি বা গোষ্ঠীর মধ্যে ভারতীয় আদিম আদিবাসী কোল তথা হো একটি জাতি বা সম্প্রদায়। সেই কোল তথা হো জাতি অভ্যন্তর বিবাহ সংস্কার নিয়ে বর্তমান আলোচ্য বিষয়।
কোল তথা হো জাতি অভ্যন্তর বিবাহ প্রধানতঃ দুই প্রকার — এক টুংকী, দিপিল, দুই, দুআর ইতুড সিঁদুর। ‘‘টুংকী দিপিল’’ কথায় টুংকী শব্দের অর্থ হলো ঝুড়ি জাতীয় এক প্রকার আধার, যা বাঁশের চেরাটি দ্বারা তৈরী। দিপিল শব্দের অর্থ হলো কোন কিছু মাথায় বহন করা। দুআর ইতুড সিঁদুর কথায় দুআর শব্দের অর্থ হলো দুয়ার (Door)। ইতুড শব্দের অর্থ হলো আঙ্গুল দ্বারা টিপ দেওয়া বা টিপ। আর সিঁদুর হলো, সেই দ্রব্য যা বিবাহিত নারীরা কপালে পরিধান করে। কোল তথা হো ভাষায় বিবাহকে আআঁদি বলা হয়। টুংকী দিপিল আআঁদি ও দুআর ইতুড সিঁদুর আআঁদি একত্রে জী সুকু আআঁদি বলা হয়ে থাকে। জী শব্দের অর্থ হলো জীবন আর সুকু শব্দের অর্থ হলো পছন্দ বা সুখ। জী সুকু আআঁদি অর্থাৎ মধ্যস্থতাকারীর মাধ্যমে পাত্র ও পাত্রী উভয় পক্ষের কথাবার্তা, দেখাশুনা ও পরস্পরের মধ্যে পছন্দের মিলন স্রোতে স্বাভাবিক ভাবে সমাজ স্বীকৃত বিবাহ।
টুংকী দিপিল — এই বিবাহের ক্ষেত্রে কনে বাড়ীর আত্মীয়-স্বজন ও কুটুম্বরা কনেসহ বিবাহের ব্যবহার্য্য সর্বপ্রকার প্রয়োজনীয় সাজ-সরঞ্জাম সঙ্গে নিয়ে বরের বাড়ীতে গমন করে ও তথায় বিবাহকার্য্য সম্পাদন করা হয়।
দুআর ইতুড সিঁদুর — এই বিবাহের ক্ষেত্রে বরের বাড়ীর লোকজন বরসহ বিবাহে প্রয়োজনীয় জিনিসপত্র নিয়ে কনের বাড়ীতে গমন করে ও তথায় বিবাহ কার্য্য সম্পাদন করা হয়।
জী সুকু আআঁদি অর্থাৎ টুংকী দিপিল ও দুআর ইতুড সিঁদুর বিবাহের ক্ষেত্রে যে সকল ক্ষেত্র-পাত্র রয়েছে, তা পর্য্যায়ানুক্রমে আলোচনা করা যাক।
রায়বার — কোল জাতি অভ্যন্তর কোন দুই পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের উদ্দেশ্যে পাত্র বা পাত্রী যে কোন একপক্ষ থেকে একজন ব্যক্তিকে মধ্যস্থতাকারী রূপে নির্ধারণ করতে হয়। এই মধ্যস্থতাকারীকে কোল ভাষায় রায়বার বলা হয়। রায়বার-এ করণী কার্য্য যথা— (ক) প্রথমতঃ প্রথমেই পাত্র ও পাত্রী তথা উভয়পক্ষের কিলি অর্থাৎ বংশ পরিচয় সম্পর্কে রায়বারকে জেনে নিয়ে উভয়পক্ষের সাথে আলোচনা করে নিতে হয়। কারণ, কোল সমাজের নিয়মানুযায়ী সমবংশের কোন দুই পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না।
আবার অনেক ক্ষেত্রে বিষম কিলি তথা বংশ হলেও বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপন করা যায় না। যেমন কোন এক বংশের সঙ্গে অন্য কোন এক বা একাধিক বিষম বংশের আদি থেকে ভাতৃত্বসুলভ সম্পর্ক থেকে থাকে। এ বিষয়ে ‘রায়বার’ তথা মধ্যস্থতাকারী পাত্র ও পাত্রী উভয়পক্ষের সঙ্গে আলোচনা করে নেয়। উভয়পক্ষ থেকে ইতিবাচক সংকেত মিললে তবেই পরবর্তী কার্য্যে রায়বার পদক্ষেপ নেয়। (খ) দ্বিতীয়তঃ ঘরবাড়ী বা পাত্র-পাত্রী দেখাশুনার উদ্দেশ্যে উভয়ের বাড়ীতে গমনের পথে রায়বার পথপ্রদর্শক রূপে কাজ করে থাকে। (গ) তৃতীয়তঃ পাত্র বা পাত্রী পক্ষকে সঙ্গে নিয়ে পথে গমন শুরুর পূর্বে একাধিক পাতাযুক্ত একটি খেজুর ডাঁটা রায়বারকে সংগ্রহ করে নিতে হয়। পাত্র বা পাত্রীপক্ষসহ রায়বার পথে গমনকালে পথের ডানে, বামে বা সামনের দিকে কোন অশুভ ঘটনা ঘটছে কি না তা রায়বারকে লক্ষ্য রাখতে হয়। যদি এমন কোন অশুভ দৃশ্যাবলী রায়বার-এর চক্ষে পরিলক্ষিত হয়, তা হলে সে পথের ডানদিকের দৃশ্যের জন্য খেজুর ডাঁটার ডান পার্শ্বের পাতায়, বামদিকের দৃশ্যের জন্য ডাঁটার বাম দিকের পাতায় এবং সামনের দিকের দৃশ্যের জন্য উভয় পার্শ্বের একটি করে পাতা নিয়ে একত্রে একটি করে গাঁট মেরে রাখে। এইভাবেই পাত্র বা পাত্রীপক্ষসহ রায়বার পথ গমনকালে নিজ দায়িত্বকর্ম পালন করে থাকে। এছাড়াও একাধিক ক্ষেত্রে রায়বার-এর অনেক কাজ রয়েছে।
রায়বার মান/মানদি — দুটি পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক স্থাপনের মূলকাণ্ডারী হলো রায়বার। তাই বিবাহকার্য্য সম্পন্নের পর কনেপক্ষ ও বরপক্ষ থেকে রায়বারকে সসম্মানে বাড়ীতে আমন্ত্রণ জানিয়ে ধুতিকাপড়, গেঞ্জি, জামা ইত্যাদি প্রদান করে সম্মানিত করা হয়। এইরূপ সম্মানিত করাকেই রায়বার মান বা মানদি বলা হয়।
ন্যাল-ন্যাপ্যাল — ‘‘ন্যাল’’ কথার অর্থ হলো দেখা আর ‘‘ন্যাপ্যাল’’ কথার অর্থ হলো পরস্পরে দেখাদেখি। এখানে ‘‘ন্যাল-ন্যাপ্যাল’’ কথার অর্থ হলো পাত্র ও পাত্রী উভয়পক্ষের মধ্যে দেখাশুনা। কোল সমাজ অভ্যন্তরে বিবাহের উদ্দেশ্য নিয়ে পাত্র-পাত্রী পরস্পরকে দেখাশুনা করানোর প্রচলন রয়েছে। পাত্র ও পাত্রীর মধ্যে দেখাশুনায় পছন্দ ও অপছন্দের দিক দু’টিও রয়েছে। এইরূপ পছন্দ ও অপছন্দের বিষয়টি মাথায় রেখে আদিতে গরীব শ্রেণীর লোকেরা কোন পরবে বা পাথর খাদানের কর্মস্থলে কোন দুই যুবক-যুবতীর মধ্যে প্রাথমিক ভাবে দেখাশুনার কাজ তৃতীয় কোন জনের ব্যবস্থাপনায় সেরে নেওয়া হতো। এইরূপ ক্ষেত্রে যুবক-যুবতী উভয়ের মনোভাব ইতিবাচক হলে সামাজিক রূপে আবারও সবাইয়ের উপস্থিতিতে দেখাশুনার ব্যবস্থা হতো। আর্থিক সামর্থ যাদের থাকে তারা সরাসরি বাড়ীতে দেখাশুনার কাজ করতো। বাড়ীতে দেখাশুনার মূল পর্ব — সাধারণভাবে পাত্রসহ পাত্রপক্ষ পাত্রীর পক্ষের বাড়ীতে গিয়ে প্রথম দেখাশুনার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এইরূপ ক্ষেত্রে পাত্রীর বাড়ীর মধ্যে বা তাদের উঠানে পাত্রীপক্ষের লোকজন খেজুর পাতার তালই বিছিয়ে বসার ব্যবস্থা করে, যা উভয়পক্ষ যেন মুখোমুখি বসতে পারে। বসার ব্যবস্থা সব কিছু ঠিকঠাক হওয়ার পর পাত্রপক্ষ ও পাত্রীপক্ষ পাত্র-পাত্রীকে সামনে বসিয়ে পিছনের দিকে উভয়পক্ষের অন্যান্যরা আসন গ্রহণ করে। পাত্রীর হাতে জলভর্তি একটি ঘটি আগেই রাখার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে, যা পাত্রী তার সামনে মাটিতে রেখে হাতের দুই চেটো দ্বারা ঢাকা দিয়ে রাখে। তারপর মধ্যস্থতাকারীর পৌরহিত্যের মাধ্যমে পাত্রপক্ষ পাত্রীকে এবং পাত্রীপক্ষ পাত্রকে নানান রূপ প্রশ্নের মাধ্যমে জিজ্ঞাসাবাদ করে থাকে, যেমন — ‘‘আম দ অকয় কআ.’ গ্যা হন’’ — অর্থাৎ তুমি কোন বংশের ভাগ্না/ভগ্নী। দেখাশুনার ক্ষেত্রে পাত্র বা পাত্রীর মামার বংশের পরিচয় জানতে চাওয়া হয়। আবার যেমন প্রশ্ন করা হয়, ‘‘আম অকয় কআ.’ বাঁদা র্যা উম্যানাস’’ — অর্থাৎ তুমি কাদের পুকুরে স্নান করো। এখানে দুই কথার বাস্তবক্ষেত্রে অর্থ হলো বাবা বা উত্তরকর্তার নিজের বংশের পরিচয়ের কথা জিজ্ঞাসা করা হচ্ছে। এছাড়া অন্যান্য কিছুও নানান প্রশ্নোত্তরের মাধ্যমে পাত্র-পাত্রীর নিকট জানতে চাওয়া হয়। দেখাশুনা কথাবার্তা ইত্যাদির শেষ পর্বে পাত্রপক্ষ পাত্রীকে কোন কিছু একটা সাম্মানিকরূপে প্রদান করে থাকে। তারপর পাত্রীর হাত থেকে পাত্র জলপূর্ণ ঘটিখানি নিজ হাতে নিয়ে বাইরে কোথাও জল ঢেলে ফেলে খালি করে দেয়। এই রূপ করার অর্থ পাত্রপক্ষ পাত্রীকে পছন্দের আওতায় নিয়েছে। আদি নিয়মানুযায়ী পাত্রীকে পছন্দ না হলে জলভর্তি ঘটি খালি করার কোন কথাই থাকে না। বর্তমানে পাত্রীকে পছন্দ না হলেও দেখাশুনার ক্ষেত্রে কাউকে সরাসরি ব্যথা না দেওয়ার উদ্দেশ্যে জলভর্তি ঘটিখানি জল ঢেলে ফেলে খালি করে দেওয়া হয়ে থাকে। সর্ব শেষে পাত্র ও পাত্রীপক্ষ পরস্পরে ‘‘জআর’’ প্রণাম বিনিময়ের মাধ্যমে দেখাশুনার পর্ব সমাপ্ত করে।
গনঙ-সাতি — কোল তথা হো সমাজে ‘গনঙ’ অর্থাৎ কনেপণ প্রদানের প্রচলন রয়েছে। এইরূপ ‘গনঙ’-এর নির্দিষ্ট মান নেই। পাত্রপক্ষ থেকে পাত্রীপক্ষকে গরু ও কিছু টাকা কনেপণ রূপে দেওয়া হয়ে থাকে। কিছু কিছু এলাকায় কনেপণ রূপে দু’টি গরু যাদের মধ্যে একটি এ্যাঁড়া ও একটি মাদি আর টাকার ক্ষেত্রে যেমন এক হাজার বা দুই হাজারের মধ্যে লেনদেন করা হয়ে থাকে। আবার কোন কোন এলাকায় আট-দশটি গরু ও টাকার ক্ষেত্রে পাঁচ থেকে দশ হাজারও কনেপণ রূপে লেনদেন-এর প্রচলন রয়েছে। ‘‘সাতি’’ হলো গনঙ-এর অনুসঙ্গ কিছু যা কনেপক্ষকে প্রদান করা হয়ে থাকে। এই এ‘‘সাতি’’ সর্বসময় সর্বাঞ্চলেই সমান। এই ‘‘সাতি’’ যেমন — ‘কুমা ম্যারম’ অর্থাৎ পাত্রীর মামার উদ্দেশ্যে প্রদেয় একটি ছাগল, ‘জিআ সাড়ী’ অর্থাৎ পাত্রীর ঠাকুর মায়ের জন্য একটি শাড়ী, ‘আজি হানার সিম’ অর্থাৎ কনের দিদিদের জন্য একটি মুরগী, ‘সালগী দাআড়ী’ অর্থাৎ সড়ুভাইকে প্রদেয় একটি ধুতি, যা সে তার পাগড়ী রূপে ব্যবহার করবে।
গনঙ সিড — ‘‘গনঙ সিড’’ অর্থাৎ গনঙ বা কনেপণ বিষয়ক আলোচনার মাধ্যমে একটা ইতিবাচক সিদ্ধান্তে আসা। পাত্র ও পাত্রী উভয়পক্ষ দ্বারা পূর্ব নির্ধারিত কোন একটি দিনে পাত্রের বাড়ীতে ‘‘গনঙ সিড’’ পর্বের ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। উভয়পক্ষের উপস্থিতিতে গনঙ বিষয়ক আলোচনায় ইতিবাচক সিদ্ধান্তের উপর পাত্রপক্ষ পাত্রীপক্ষকে গনঙ প্রদানের ব্যবস্থা করে। অনেক সময় গনঙ সিড পর্বে উভয়পক্ষের মধ্যে গনঙ বিষয়ক দর কষাকষিতে এক মত না হলে উক্ত ক্ষেত্রেই নেতিবাচক পরিস্থিতির মধ্য দিয়ে আলোচনা ভঙ্গ হয় তথা উক্ত দুটি পরিবারের মধ্যে বৈবাহিক সম্পর্ক গড়ে ওঠে না। ‘‘গনঙ সিড’’ পর্ব ইতিবাচক হলে গনঙ প্রদানের ব্যবস্থার সাথে সাথে ‘‘ডিআঙ’’ নামক পানীয় মাদক সেবনের ব্যবস্থা করা হয়। উভয়পক্ষের মধ্যে নাচ-গান চলে। এই ক্ষেত্রে যে সকল গান গাওয়া হয় তাদেরকে ‘‘বালা দুরাঙ’’ বলা হয়। ‘‘বালা দুরাঙ’’-এর অর্থ হলো বেহাই বেহানীর গান। এই ‘‘বালা দুরাঙ’’-এর কয়েক পংক্তি উল্লেখ করা যায়, যথা —
ন্যাল-ন্যাপ্যাল হবাএ্যানা বালা
সুকু সানাঙ হবাএ্যানা বালা। (২)
গনঙ সিপিড হবাএ্যানা বালা
গনঙ তিনিল হবাএ্যানা বালা (২)
অর্থাৎ পরস্পরে দেখাদেখি হলো, সকলে পছন্দের আওতায় এলো, গনঙ বিষয়ক আলোচনার মাধ্যমে গনঙ প্রদানও হলো। ‘‘গনঙ সিড’’ পর্বে ‘‘গনঙ’’ প্রদানের পর পাত্রের বাড়ীতে খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। এইরূপ খাওয়া দাওয়ার ব্যবস্থাকে ‘চাটু নলাড’ বলা হয়ে থাকে। ‘‘গনঙ সিড’’ পর্বে সকল কার্য্য সমাপ্ত হলে পর কনেপক্ষকে পাত্রপক্ষ থেকে প্রণাম বিনিময় ও নাচ-গানের মধ্য দিয়ে বিদায়ের ব্যবস্থা করা হয়।
বাপালা — ‘‘বাপালা’’ শব্দের অর্থ হলো বেহাই-বেহানীদের মধ্যে পরস্পরের যে সম্পর্ক বা তাদের মধ্যে যে কাজ। ‘‘বাপালা’’ কথাটি এসেছে ‘‘বালা’’ কথা থেকে। ‘‘বালা’’ কথার অর্থ হলো বেহাই বা বেহানী। ‘‘বালা’’ কথার তিনটি রূপ হয়ে থাকে, যথা — ‘‘বালা’’ — ‘‘বাপালা’’ — ‘‘বাবালা’’। ‘‘গনঙ সিড’’ পর্বের পর পাত্রীর বাড়ী ‘‘বাপালা’’ পর্ব অনুষ্ঠিত হয়। এই ‘‘বাপালা’’ পর্বে পাত্রপক্ষ পাত্রীর বাড়ীতে গিয়ে পাত্রীকে বরণ স্বরূপ একটা কিছু উপহার দিয়ে থাকে। এইরূপ ক্ষেত্রেও খাওয়া দাওয়া ও নাচগান হয়ে থাকে। এই ‘‘বাপালা’’ পর্বকে আবার ‘‘জমহাল’’ও বলা হয়।
আআঁদিন দিলাঙ — ‘‘আআঁদিন দিলাঙ’’ অর্থাৎ বিবাহের দিন। কোল তথা হো সমাজের অনুশাসন বা রীতি অনুযায়ী জন্ম ও মৃত্যুজনিত পারিবারিক বা গ্রাম্য অশৌচ পরিস্থিতি, অমাবস্যার দিন ও সূর্যগ্রহণ-চন্দ্রগ্রহণ কাল ব্যতীত বছরের সকল দিনেই বিবাহকার্য্য সম্পাদন করা যায়।
আআঁদিন দিপিলঙ — ‘আআঁদিন দিপিলাঙ’’ অর্থাৎ বিবাহের শুভ সময়। আবার এই ‘‘আআঁদিন দিপিলাঙ’’কে ‘‘আআঁদিন বাআসা’’ বা ‘‘বাড়াসা’’ বলা হয়, যাকে বাংলায় তিথি বলা যায়। কোল সমাজের নীতি অনুযায়ী বিবাহের শুভ সময় হলো ‘‘সিঁগীতুর দিপিলাঙ’’ অর্থাৎ সূর্য উদয় কাল।
লুঁকুদি — ‘‘লুঁকুদি’’ কথার ব্যবহারিক অর্থ হলো কোলবর-কোলকনে। ‘‘লুঁকুদি’’ কথাটি এসেছে ‘‘লুক’’ বা ‘‘লুকু’’ কথা থেকে। লুক বা লুকু কথার অর্থ হলো জোড় বা জোড়া। কোল সমাজের বিশ্বাস সিঙবঁগা অর্থাৎ সূর্য্যদেবতার ঔরসে এক জোড়া মানুষ তথা একজন মানব ও মানবী জননী ধরনীবক্ষে সৃষ্টি হয়েছিলেন। এঁদেরই নাম হয়েছিল ‘‘লুকু’’ ও লুকুমী। এই ‘লুকু’ ও ‘লুকুমী’কেই কোল জাতির মানুষরা ‘‘লুকু হাড়াম’’ ও ‘‘লুকু বুড়ী’’ বলে থাকে। কোল ভাষা ব্যাকরণ রীতিতে ‘‘লুকু’’ কথাটি বিশেষ্য রূপ হবে লুনুকু বা লুঁকু। লুঁকু + ইদি = লুঁকুদি। ‘‘ইদি’’ কথার অর্থ হলো নেওয়া বা নিয়ে যাওয়া। এখানে ‘‘লুঁকুদি’’ কথার অর্থ হলো জুড়ি বা জোড়া নিয়ে যাওয়া। এইরূপ অর্থের ‘‘লুঁকুদি’’ শব্দখানি পরবর্তীকালে সম্পূর্ণভাবে বিশেষ্য রূপে পরিণত হয়েছে। এখন ‘‘লুঁকুদি’’ বললে যা বোঝায়, তা হলো বারো বছরের নিম্ন বয়সী একজন বালক ও বালিকা যারা, তথা বালকটি বরের সাথে এবং বালিকাটি কনের সাথে সঙ্গ দিয়ে থাকে। এরা বর ও কনের গায়ে তেল-হলুদ মাখানোর দিন থেকে বিবাহের সমাপ্ত মুহূর্ত পর্যন্ত বর ও কনের সঙ্গ দেওয়ার কাজ করে। এদেরকেও স্নান করানো ও তেল-হলুদ মাখানো হয়ে থাকে। কোল সমাজের বিশ্বাস এই লুঁকুদিদ্বয়ই হলো কোল জাতির আদি পিতামাতা লুকু হাড়াম-লুকুমী বুড়ী, যাদের উপস্থিতিতে বর ও কনেকে কোন বিপদ বা অশুভ কিছু স্পর্শ করতে পারে না। তাই, কোল সমাজের বুকে অদ্যাবধি বিবাহক্ষেত্রে বর ও কনের সাথে ‘‘লুঁকুদি’’-দ্বয়কে রাখার প্রচলন রয়েছে।
আআঁদি সাকি — ‘‘আআঁদি সাকি’’ অর্থাৎ বিবাহক্ষেত্রের সাক্ষী। হিন্দু সমাজে বর ও কনের বিবাহ ক্ষেত্রে যে রূপ অগ্নিসাক্ষী রাখতে হয়, অনুরূপে আদিবাসীয় কোল তথা হো সমাজ অভ্যন্তর বিবাহক্ষেত্রেও সাক্ষী রাখতে হয়, তবে এই ক্ষেত্রে সাক্ষী সংখ্যা অনেক, যেমন — প্রথমতঃ ‘‘লুঁকুদি’’ অর্থাৎ কোলবর ও কোলকনে, যাদেরকে কোলজাতির আদি পিতামাতা লুকু হাড়াম-লুকুমী বুড়ীরূপে উপস্থিত করানো হয়। দ্বিতীয়তঃ ‘‘প্যাড়া-কুপুল’’ অর্থাৎ কুটুম্বগণ, যারা বিবাহানুষ্ঠানে নিমন্ত্রিত হয়। তৃতীয়তঃ ‘‘দুনুমী এ্যাঁগা’’ অর্থাৎ ধরিত্রীজননী, যার বক্ষে মানবকুলের সৃষ্টি। চতুর্থতঃ ‘‘সিঙবঁগা’’ অর্থাৎ সূর্য্যদেবতা, কোলজাতির সর্বশক্তিমান পিতা, যাঁর ঔরসজাত সন্তান হলো কোলজাতির মানুষজন। ‘‘সিঙবঁগা’’-ই হলো মহা অগ্নিপিণ্ড রূপ প্রধান সাক্ষী। এই সিঙবঁগাকে সাক্ষী রাখার উদ্দেশ্যে কোলজাতি অভ্যন্তর বিবাহ সকালবেলায় সম্পাদিত হয়ে থাকে।
আআঁদি দিলি কবর — ‘‘আআঁদি দিলি’’ অর্থাৎ বিবাহ নিমন্ত্রণ। কোন একটি দিন বিবাহানুষ্ঠানের জন্য নির্ধারণের পর ওই দিনটিকে উদ্দেশ্য করে পাত্র ও পাত্রীপক্ষ স্ব-স্ব কুটুম্বদের নিমন্ত্রণ করে এবং আত্মীয়দের কবর অর্থাৎ খবর পাঠায়। কোল তথা হো সমাজের নিয়মানুযায়ী ‘দিলি’ অর্থাৎ নিমন্ত্রণের ক্ষেত্রে পরিবারের কোন ব্যক্তি বা অন্য কোন ব্যক্তির মাধ্যমে কুটুম্বদের ‘দিলি’ করা হয়। দিলি-এর ক্ষেত্রে কোল সমাজের রীতি অনুসারে কয়েকটি চাল ও সুপারীতে হলুদ লাগিয়ে তার সঙ্গে দূর্বাঘাসকে একটি শালপাতায় চিটি অর্থাৎ মোড়ক করে, ওই মোড়ক পাত্র ও পাত্রীপক্ষ স্ব-স্ব কুটুম্বদের বাড়ীতে পাঠিয়ে দিয়ে থাকে ও কথার মাধ্যমে বিবাহানুষ্ঠানের দিনটি জানিয়ে দেওয়ার প্রচলন রয়েছে। সুপারী দুই প্রকার হয়ে থাকে, এক— অর্ধ সুপারী, দুই— গোটা সুপারী। সকল কুটুম্বদের একই রকম সুপারীতে নিমন্ত্রণ করা হয় না। যারা আর্থিক অবস্থায় দু্র্বল তাদেরকে অর্ধ সুপারী দ্বারা এবং যারা আর্থিক অবস্থায় স্বচ্ছল তাদেরকে গোটা সুপারী দ্বারা নিমন্ত্রণ করা হয়। আত্মীয়দের নিমন্ত্রণ করার রীতি নেই। বিবাহানুষ্ঠানের ক্ষেত্রে খবর পাঠানো হয় ও প্রয়োজনে আর্থিক সাহায্য চাওয়া হয়ে থাকে।
মানসাতি — ‘‘মানসাতি’’ অর্থাৎ নিমন্ত্রিত কুটুম্বগণের কুটুম্বিতা রক্ষার্থে আনিত প্রদেয় কিছু। নিমন্ত্রিত কুটুম্বগণ একটি সুপারীর ক্ষেত্রে ‘‘দুই হাঁড়ি ডিআঙ’’ অর্থাৎ চালের পচুই পানীয় মাদক, দুই ঝুড়ি আনাজ এবং অর্ধ সুপারীর ক্ষেত্রে এক হাঁড়ি ডিআঙ ও এক ঝুড়ি আনাজ বিবাহ অনুষ্ঠানে নিয়ে আসে। তার সঙ্গে পাত্রপক্ষের কুটুম্বরা পাত্রের জন্য ধুতি, গেঞ্জি, জামা ও কনের ক্ষেত্রে কনেপক্ষের কুটুম্বরা শাড়ী, ব্লাউজ ও সায়া কনের জন্য সম্মান রক্ষার্থে আনয়ন করে।
দ্যাঁগা-হারম — ‘‘দ্যাঁগা’’ কথার অর্থ হলো সাহায্য, যা একক বা একাধিক জন দ্বারা। ‘হারম’ কথার অর্থ হলো বহুজন দ্বারা আলোচনা ভিত্তিক সাহায্য বা, যে যতটা সাহায্য দিতে সক্ষম। কোন পরিবার শুধু বিবাহের ক্ষেত্রে নয়, কোন পূজা-পার্বণ বা শ্রাদ্ধ-শান্তি কর্মের ক্ষেত্রে আর্থিক দিক দিয়ে অপারগ হলে সমাজের মানুষ সেই পরিবারকে সাহায্য সহযোগিতা করে থাকে। এইরূপ ক্ষেত্রে ‘‘দ্যাঁগা-হারম’’ করার রীতি কোল সমাজে রয়েছে।
রুনুঁআ — ‘‘রুনুঁআ’’ অর্থাৎ বাদ্যযন্ত্র। কোল সমাজ অভ্যন্তর বিবাহ ক্ষেত্রে যে সকল বাদ্যযন্ত্র ব্যবহার করা হয়, তা হলো — ‘‘দামা’’ (নাগর) অর্থাৎ ধামসা, ‘‘দুমাঙ’’ অর্থাৎ মাদল, ‘‘রুতু’’ তথা বাঁশি ‘‘বানাম’’ অর্থাৎ বেহালার ন্যায় বিশেষ এক যন্ত্র ও ‘‘র্যাতা’’ অর্থাৎ বাঁশের খণ্ডকে চেরাটি যোগে তৈরী বাদ্যযন্ত্র।
চামডা — বর ও কনে বাড়ীর উঠানে আম-জাম ইত্যাদি গাছের ডালপালা দ্বারা এক প্রকার আচ্ছাদন তৈরী করা হয়, যার ছায়ায় আত্মীয়-স্বজন কুটুম্বরা উঠা-বসা করে, পানীয় মাদক সেবন ও নাচ-গান করে থাকে। দুআর ‘‘হতুড় সিঁদুর’’ বিবাহের ক্ষেত্রে কনে বাড়ীর উঠানে চামডা তলাতেই বিবাহের মূলপর্বের কার্য্য সম্পাদিত হয়ে থাকে।
কাঁদাসাল — বর ও কনে বাড়ীর অনতি দূরে আরও একটি করে ‘‘চামডা’’ তৈরী করে রাখতে হয়। এই ‘‘চামডা’’-কেই কাঁদাসাল বা কাঁদাসাড় বলা হয়। কনে বাড়ীর কাঁদাসাল-এ বরযাত্রীরা এবং বরের বাড়ীর কাঁদাসাল-এ কনেযাত্রীরা আশ্রয় নিয়ে থাকে। তা ছাড়া তথায় নিজেরা রান্না-বান্না ও খাওয়া-দাওয়া করে থাকে এবং পানীয় মাদক সেবন সহকারে ধামসা-মাদল বাজিয়ে সারারাত্রি ব্যাপী নাচগান করে থাকে।
ডিআঙ আকিড — কোল জাতি অভ্যন্তর যে কোন সামাজিক অনুষ্ঠানে ‘‘ডিআঙ’’ নামক এক প্রকার পানীয় মাদক ব্যবহার করার প্রচলন রয়েছে। তাই, কোল সমাজের বিবাহ অনুষ্ঠানের ক্ষেত্রেও ডিআঙ ব্যবহার করা হয়। ‘‘ডিআঙ আকিঙ’’ কথার অর্থ হলো চিআঙ প্রস্তুত করা তথা বানানো।
সুনুম-সাসাঙ — ‘সুনুম’ অর্থাৎ তেল ও ‘‘সাসাঙ’’ কথার অর্থ হলো হলুদ। এখানে ‘‘সুনুম-সাসাঙ’’ কথার অর্থ দাঁড়ায় বর ও কনেকে স্নান করানো ও তেল-হলুদ মাখানো। কোল সমাজ অভ্যন্তর বিবাহে নির্ধারিত বিবাহ তারিখের পূর্বের দিনগুলিতে যথা — তিনদিন বা পাঁচদিন অথবা সাতদিন, কেহ কেহ পনের দিন আগের থেকে পাত্রকে পাত্রের বাড়ীতে এবং কনেকে কনের বাড়ীতে স্নান করানো ও তেল-হলুদ মাখানো হয়ে থাকে। এই সময় থেকে বরের সঙ্গে একজন কোল বর ও কনের সঙ্গে একজন কোল কনেকে রাখতে হয়। এদেরকেই কোল ভাষায় ‘লুঁকুদি’ বলা হয়। আবার এই সময় থেকেই পাত্র ও পাত্রী বর-কনিয়াঁ অর্থাৎ বর-কনে রূপে গণ্য হয়। লুঁকুদিদ্বয়কেও বর ও কনের সাথে স্নান করানো ও তেল-হলুদ মাখানো হয়ে থাকে। স্নান করানো ও তেল-হলুদ মাখানোর দায়িত্বে থাকে — কোল সমাজের নারীরা। তেল-হলুদ গায়ে মাখানোর সময় গানও হয়ে থাকে, যেমন —
কনের ক্ষেত্রে (১) এ্যাঁগাম ম্যা ক সাসাঙ মাঈর্যা,
আপুম স্যা ক সুলুম,
মিতি চি ক ম্যাসা তাড
মিতি মদল মদল।
(২) হালার ম্যা ক সাসাঙ মাঈর্যা
হয়াঁর ম্যা ক সুনুম মাইর্যা,
গিতিল চি ক ম্যাসা তাডা
গিতিল স্যাগয় স্যাগয়।
অর্থাৎ, কনেকে বলা হচ্ছে — (১) তোমার মা-বাবা তেল-হলুদ, যাতে মিথী মিশানো রয়েছে, ফলে সুগন্ধ ছড়াচ্ছে। (২) তোমার শ্বশুর শাশুড়ীর তেল-হলুদ, যাতে বালি মিশানো রয়েছে, ফলতঃ রক রক করছে। বরকে তেল-হলুদ মাখানোর সময়ও এই গান গাওয়াহয়, তবে বরের ক্ষেত্রে ‘‘মাঈ’’ না বলে ‘‘বয়অ’’ বলা হয়ে থাকে।
বর-কনিয়াঁ সাঁজুর/সাজম — ‘‘বর-কনিয়াঁ’’ অর্থাৎ বর-কনে, ‘‘সাঁজুর’’ বা ‘‘সাজম’’ অর্থাৎ পোষাক তথা সাজানোর উদ্দেশ্যে পরিহিত বস্ত্র। আদিতে বরের পোষাক রূপে পরনে তথা কোমরে পাঁচীকাপড় ও মাথায় দাআড়ী অর্থাৎ পাগড়ী ব্যবহারের প্রচলন ছিল। বর্তমানে ধুতি কাপড়, পাঞ্জাবী জামা ও মাথায় ‘টপরা’ অর্থাৎ টোপর বরের পোষাক রূপে ব্যবহার করার প্রচলন হয়েছে। আদিতে কনের পোষাক রূপে ছিল লালপাড় যুক্ত দুটি ছোট ছোট সাদা কাপড়, তাদের মধ্য থেকে একটি কোমর থেকে নিম্নদেশে পরিহিত থাকত আর একটি বক্ষ দেশে ঢাকা দেওয়া হতো। এই দু’টি কাপড়কে ‘লাআঁগা’ বলা হয়। বর্তমানে কনে বিবাহের সময় লালপাড়যুক্ত সাদা কাপড় ব্যবহার করে থাকে, যা হলুদ-তেল মাখার সময় হলুদ লেগে হলদে হয়ে যায়। সাদা কাপড় এইরূপ হলদে হওয়ার চিরস্রোতে গা মিলিয়ে বর্তমানে সহজলভ্য লালপাড়যুক্ত হলদে শাড়ী ব্যবহারের প্রচলন হয়ে গেছে। এছাড়া কনের মাথায় সোলার মুকুট পরানো হয়।
স্যাক্যাম — ‘স্যাক্যাম’ অর্থাৎ অলংকার। আদিতে কনের অলংকার রূপে যে সকল ছিল তা হলো, যেমন — মাথার খোপায় পানকাটা, কানাসী, নাকে নাক মাচী (পুলী), কানে দুল, গলায় টাকার মালা, হাতে চুর বড়া, পায়ে আআঁদু, কাডুআ প্রভৃতি।
সাতীসান — ‘সাতীসান’ অর্থাৎ উপকরণ, যা বিবাহের মূলকার্য সম্পাদনের জন্য প্রয়োজন হয়। ‘‘দুআর ইতুড সুঁদুর’’ অর্থাৎ কনের বাড়ীতে বিবাহ সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বর পক্ষ থেকে যে সকল উপকরণ তথা প্রয়োজনীয় সাজসরঞ্জাম নিয়ে যাওয়া হয়, সেগুলি যেমন — ডালা, কাঁসার থালা, শাঁখা-সিঁদুর, লোহার চুড়ি, তেল-হলুদ, মিথী, মালা-ঘুমসী, কাপড়, আয়না-চিরুনী, খেজুর পাতার নতুন তালই ইত্যাদি। শাঁখা-সিঁদুর ও লোহার চুড়ি ব্যতীত কনেপক্ষ অন্যান্য সকলই সমরূপে ব্যবস্থা করে থাকে।
এ্যার্যা বঁগা — ‘এ্যার্যা’ কথার অর্থ হলো বাধা বা অশুভ। ‘বঁগা’ কথার অর্থ হলো দেবতা যা পূজা করা হয়। ‘‘এ্যার্যা বঁগা’’ অর্থাৎ বিবাহ ক্ষেত্রের বাধা বা অশুভ কিছু খণ্ডন বা দূর করার উদ্দেশ্যে যে পূজা করা হয়। বর বা বর-কনে যে পথে গমন বা আগমন ঘটায় সেই পথের উপর যে কোন একটি স্থানে ‘‘এ্যার্যা বঁগা’’ করা হয়ে থাকে। এই ‘‘এ্যার্যা বঁগা’’-এর স্থানে পূজকের পূজা করবার সময় রায়বার অর্থাৎ মধ্যস্থতাকারীসহ বর-কনে তথা উভয়পক্ষের লোককে উপস্থিত থাকতে হয়। পূজার স্থানে বাধা বা অশুভ-এর খণ্ডন বিষয়ে পূজককে রায়বার সহযোগিতা করে থাকে। রায়বার-এর সঙ্গে থাকে পাতাযুক্ত একটি খেজুর ডাঁটা যার পাতায় রয়েছে অশুভ লক্ষণের গাঁটযুক্ত তালিকা — যা কনে ও বরের বাড়ী প্রথম দেখতে যাওয়ার পথে রায়বার এক এক করে তালিকাভূক্ত করেছিল। রায়বার যে সকল বিষয়ে পূজককে ক্রমে বর্ণনা দিয়ে থাকে। আর তারই ভিত্তিতেই পূজক পূজা করে অশুভ-এর দিকগুলি খণ্ডন করে। এই পূজায় মোরগ-মুরগী বলি দেওয়া হয়ে থাকে। ‘‘ডিআঙ’’ নামক পানীয় মাদকেরও ব্যবস্থা থাকে। এই ‘‘এ্যার্যা বঁগা’’ বিবাহের পূর্বে বিবাহের দিন বা তার পূর্বে যেকোন দিনই করা যায়। বর বা বর-কনের গমন বা আগমনকালে ‘‘এ্যার্যা বঁগা’’-এর স্থান বর-কনের মাড়িয়ে যাওয়ার নিয়ম রয়েছে।
রাআসা হাউঁসী — ‘‘রাআসা’’ অর্থাৎ আনন্দ বা ইচ্ছা, আর হাউঁসী অর্থাৎ নাচ-গান ইত্যাদিতে দীর্ঘ আগ্রহী বা আশক্তিজন। এখানে ‘‘রাআসা হাউঁসী’’ কথার ভিত্তিতে বলা যায় যে, কোল সমাজ অভ্যন্তর কোন বিবাহানুষ্ঠানে ধামসা-মাদল বাজিয়ে নাচ-গানের আখড়া হয়ে থাকে। এই আখড়ায় নিমন্ত্রিত কুটুম্বগণ ছাড়াও পাশাপাশি গ্রামগুলি থেকে কোল জাতির অনিমন্ত্রিত যুবক-যুবতীগণ ধামসা-মাদল বাজিয়ে নাচ-গান করে আনন্দ উপভোগ করার উদ্দেশ্যে শ’য়ে শ’য়ে ধেয়ে এসে অংশগ্রহণ করে থাকে। আখড়ায় অংশগ্রহণকারী অনিমন্ত্রিত যুবক-যুবতীদেরকেই ‘‘রাআসা হাউঁসী’’ বলা হয়। এইরূপ ‘‘রাআসা হাউঁসীদের উদ্দেশ্যে বরের বাড়ীতে বরের পক্ষের মালিক ও কনের বাড়ীতে কনের পক্ষের মালিক ‘‘রাআসা হাউঁসী ডিআঙ’’ অর্থাৎ রাআসা হাউঁসীদের জন্য আলাদা ভাবে পানীয় মাদক হাঁড়ির ব্যবস্থা করে থাকে।
সুরতুলী — কোল সমাজ অভ্যন্তর বিবাহক্ষেত্রের বর ও কনে যাত্রীদের সুরতুলী বলা হয়। বর ও কনের বাড়ীতে নিমন্ত্রিত কুটুম্ব ছাড়াও অনিমন্ত্রিত যুবক-যুবতীরা যারা নাচের আখড়া নাচ-গান করে মাতিয়ে তোলার জন্য উপস্থিত হয়, তারাও বর ও কনে যাত্রীদের সঙ্গে সুরতুলীরূপে অংশগ্রহণ করতে পারে।
গমন পথে বর-কনেযাত্রী ও বর-কনে — আদিতে ‘‘দুআর ইতুড সিঁদুর’’ বিবাহের ক্ষেত্রে বরকে বরযাত্রীদের সঙ্গে বা বর-কনেকে বরযাত্রী ও কনেযাত্রীদের সঙ্গে পায়ে হেঁটেই তাদের গন্তব্যস্থলে পৌঁছতে হতো। তাদের সঙ্গে থাকতো ধামসা-মাদল, রুতু অর্থাৎ বাঁশের বাঁশি, বানাম অর্থাৎ বেহালার ন্যায় এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র ও র্যাতা নামক বাঁশের খণ্ডে তৈরী এক প্রকার বাদ্যযন্ত্র। যাত্রাপথে বাদ্যযন্ত্রের তালে তালে প্রতিটি যাত্রীর কণ্ঠে ভেসে উঠত বিবাহের বিভিন্ন প্রকার গান। আবার এই গান ও বাদ্যযন্ত্রের বাজনা মাঝে মধ্যে সেখানেই থেমে যেত, যেখানে কোন নদী যদি পথের মেরুদণ্ডকে বিভাজিত করে রাখতো। কারণ কোল সমাজের আদি নিয়মানুযায়ী নদী বক্ষে বিবাহের গান গাওয়া ও বিবাহের বাজনা বাজানো নিষেধ ছিল। আবার শুকনো নদীতে হোক আর জল ভরা নদীতে নৌকার মাধ্যমে হোক বর ও কনেকে এক সঙ্গে পার করানো হতো না। বর ও কনেকে শুকনো নদীতে পার করানোর সময় কোন ব্যক্তি কাঁধে বা কাখে তুলে একজনকে পার করানোর পর আর একজনকে পার করাতো। অপরদিকে জলভরা নদীতে নৌকার মাধ্যমে পেরোনোর সময়ও কোলে রেখে বা কাখে তুলে বর-কনেকে এক এক করে পার করাতে হতো। বর-কনেকে সরাসরি নৌকায় বসতে দেওয়া হতো না। নদী পেরোনোর পর বর-কনে যাত্রীরা আবার বাজনার তালে তালে তাদের কণ্ঠে বিবাহের গান ফুটিয়ে তুলত। কোল সমাজের এই আদি নিয়মগুলি বর্তমানেও রয়েছে।
দারম/এ্যালা দারম — কোল ভাষায় ‘‘দারম’’ কথার অর্থ হলো আটকানো বা প্রতিবন্ধকতা সৃষ্টি করা। ‘‘এ্যালা দারাম’’ কথার অর্থ যথা — কোল একজন যাত্রী বা যাত্রীদের গতিপথ আটকিয়ে তাঁকে বা তাঁদেরকে সসম্মানে তাঁদের গন্তব্যস্থলে নিয়ে আসা। কোল সমাজ অভ্যন্তর বিবাহের ক্ষেত্রে যখন বরসহ বরযাত্রীরা কনে বাড়ীর অনতিদূরে পৌঁছায়, তখন কনেপক্ষের লোকজন বাড়ী থেকে বেরিয়ে ধামসা-মাদল বাজিয়ে গান করতে করতে বরসহ বরযাত্রীদের গতিপথ আটকায়। এইরূপ গতিপথ আটকানোকে দারম বলা হয়। এই দারম স্থলে দুই পক্ষ ধামসা-মাদল বাজিয়ে নাচ করতে করতে তুমুলভাবে গানের প্রতিযোগিতা চালায়। এমন পরিস্থিতির মধ্যেই কনেপক্ষের কতিপয় ব্যক্তি পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী বরযাত্রীদেরকে ‘‘ডিআঙ’’ অর্থাৎ পানীয় মাদক সেবন করায়। পানীয় মাদক সেবনান্তে নাচ ও গানের প্রতিযোগিতার মধ্য দিয়ে কনেপক্ষের লোকজন বরসহ বরযাত্রীদের ক্রমে কনেবাড়ীর অভিমুখে এগিয়ে নিয়ে আসে। যাত্রীদের পথ আটকিয়ে পরে গন্তব্যস্থলের দিকে সসম্মানে এগিয়ে নিয়ে আসাকেই ‘‘এ্যালা দারম’’ বলা হয়। অপরদিকে বর-কনে সহ কনেযাত্রীরা যখন বরের বাড়ীর অনতিদূরে পৌঁছায়, তখন তাদের ক্ষেত্রেও বরপক্ষের লোকজন সমরূপ ব্যবহার করে থাকে।
সুরতলী কাটা আবুঙ — ‘‘সুরতুলী কাটা আবুঙ’’ অর্থাৎ বরযাত্রী ও কনেযাত্রীদের পা ধুয়ানো। কোল সমাজের সামাজিক রীতি বরযাত্রীরা কনের বাড়ীতে এবং কনেযাত্রীরা বরের বাড়ীতে পৌঁছানোর পর বাড়ীর মহিলারা তেল-হলুদ সহকারে তাদের পা ধুইবার ব্যবস্থা করে। প্রত্যেক সুরতুলীর পা ধুয়ানোর সময় ধৌতকারিনীর সঙ্গে ‘জআর’ (প্রণাম) বিনিময় করে থাকে ও তাদেরকে বসানোর ব্যবস্থা করা হয়। সর্বশেষে ‘‘ডিআঙ’’ নামক পানীয় মাদক প্রত্যেকের জন্য ব্যবস্থা করা হয়ে থাকে। তারপর বরসহ সুরতুলীরা কনেবাড়ীর অনতিদূরে তৈরী করা কাঁদাসাল তথা আশ্রয়স্থলে গমন করে ও তথা আশ্রয় নেয়।
সঙ চাউলী — ‘‘সঙ’’ কথার অর্থ হলো পরিমাপ করা এবং ‘‘চাউলী’’ কথার অর্থ হলো চাল। এখানে ‘‘সঙ চাউলী’’ এই দু’টি কথার অর্থ রূপে যা প্রকাশ করা যায়, তা হলো — বরপক্ষের সুরতুলী তথা বরযাত্রীরা কনেবাড়ীতে পৌঁছানোর পর পূর্ব নির্ধারিত পরিমাণ অনুযায়ী বরযাত্রীদেরকে কনেপক্ষ রান্না-বান্না খাওয়া-দাওয়ার উদ্দেশ্যে চাল, ডাল, শাকসব্জি, মাংস, ডিআঙ চাটু অর্থাৎ হাঁড়িয়া হাড়ি ইত্যাদি পরিমাপ করে প্রদান করে থাকে। আবার কনেপক্ষের সুরতুলীরা যখন বরের বাড়ীতে পৌঁছায়, তখন বরপক্ষ থেকেও সমরূপে পানীয় ও খাদ্যদ্রব্যাদি প্রদানের ব্যবস্থা করা হয়। উভয়পক্ষ থেকে খাদ্যদ্রব্যাদি পরিমাপ করে পরস্পরের আদান-প্রদানকে ‘‘সঙ চাউলী’’ বলা হয়। এখানে আর একটু পরিষ্কার করে বলা যায়, বরপক্ষের সুরতুলীরা কনে পক্ষের নির্মিত কাঁদাসালে এবং কনেপক্ষের সুরতুলীরা বরপক্ষ নির্মিত কাঁদাসালে নিজেরাই নিজেদের রান্না-বান্না ও খাওয়া-দাওয়ার ব্যবস্থা করে থাকে।
আআঁদি তাএম — ‘‘আআঁদি তাএম’’ অর্থাৎ বিবাহকার্য্য সম্পাদনের স্থান। ‘‘দুআর ইতুড সিঁদুর’’ বিবাহের ক্ষেত্রে কনে বাড়ীর উঠানের চামডা তলায় এবং ‘‘টুংকী দিপিল’’ বিবাহের ক্ষেত্রে বরের বাড়ীর উঠানে বিবাহকার্য্য সম্পাদন করা হয়ে থাকে।
সিমিসি — ‘‘সিমিসি’’ অর্থাৎ বিবাহকার্য্য সম্পাদনকারিনী তথা মহিলা। বিবাহ-কার্য্যের মূলপর্ব সম্পাদন করে থাকে বর ও কনেপক্ষের মহিলারা। দুই পক্ষের দু’টি মহিলা দল থাকে। দু’টি দলের দু’টি প্রধান থাকে, যার মধ্য থেকে একজন বরের বৌদি এবং অন্যজন কনের সঙ্গে বৌদি সম্পর্কে সম্পর্কিত ব্যক্তি। এই দুই মহিলা প্রধানকে ‘‘সিমিসি’’ বলা হয়। সিমিসিদ্বয় যে কার্য্যগুলি করে থাকে, সেই কার্য্যে অন্যান্য মহিলা সহযোগিতা করে থাকে।
আআঁদি মুতুল পানাব — ‘‘আআঁদি মুতুল পানাব’’ অর্থাৎ বিবাহের মূলপর্ব। বিবাহের মূলপর্ব দুই ভাগে বিভাজিত। যথা — (ক) চুমাল (খ) সিপিঁদুর ।
(ক) চুমাল — ‘চুমাল’ (চুমাঙ) অর্থাৎ বরন/বিবাহকার্য সম্পাদনের উদ্দেশ্যে বর ও কনে পক্ষের মহিলারা তাদের পূর্বপ্রস্তুতি অনুযায়ী কনেবাড়ীর চামডা তলায় বর ও কনেকে নিয়ে উপস্থিত হয় ও তথায় উভয়পক্ষ থেকে খেজুর পাতায় তৈরী একটি করে নতুন তালই পাশাপাশি বিছানোর ব্যবস্থা করে। তারপর কনেপক্ষের তালইতে কনেকে এবং বরপক্ষের তালইতে বরকে পূর্বমুখী করে বসানো হয়। বরকে কনের ডান দিকে বসানোর রীতি রয়েছে। এইরূপ অবস্থায় কনে পক্ষের সিমিসি তথা প্রধান কনেকে এবং বরপক্ষের সিমিসি বরকে তেল-হলুদ মাখাতে মাখাতে তেল-হলুদ মাখানোর গান গাইতে থাকে। এই গানে অন্যান্য মহিলারা সঙ্গত দিয়ে থাকে। এরপর বিপরীতে তথা কনেপক্ষের সিমিসি বরকে এবং বরপক্ষের সিমিসি কনেকে আবারও গায়ে তেল-হলুদ মাখিয়ে মাথার চুল আঁচড়িয়ে ভাল করে সাজিয়ে তোলে। তারপর উভয় সিমিসি দু’টি কাঁসার থালার উপর শালপাতার তৈরী প্রদীপে বাতি জ্বালিয়ে আরতি করনের ন্যায় থালা দুলিয়ে ঘুরিয়ে বর ও কনেকে বরণ করে থাকে। এইরূপ ক্ষেত্রকেই চুমাল বলা হয়।
(খ) সিপিঁদুর — ‘‘সিপিঁদুর’’ কথার অর্থ এখানে যা দাঁড়ায়, তা হলো বরের হাত দিয়ে কনের কপালে এবং কনের হাত দিয়ে বরের কপালে সিঁদুর লাগানো। বর-কনে পরস্পরকে সিঁদুর লাগানোর পূর্বে বরের সিমিসি বরের হাত দিয়েই শাখা ও লোহার চুড়ি কনের দুই হাতে লাগানোর ব্যবস্থা করে। তারপর বরের সিমিসি প্রথমে বরের হাত দ্বারা কনের কপালে সিঁদুর লাগিয়ে থাকে। এই রূপ সিঁদুর কনের কপালে লাগানোর সাথে সাথেই কনেপক্ষের সিমিসি তার নিজ শাড়ীর আঁচল দ্বারা তা মুছে ফেলার ব্যবস্থা করে। এরপর কনের সিমিসি কনের হাত দ্বারা বরের কপালে সিঁদুর লাগিয়ে থাকে। তাও আবার বরের সিমিসি নিজ শাড়ী কাপড়ের আঁচল দ্বারা মুছে ফেলে। এইরূপে বর ও কনের কপালে সিঁদুর প্রলেপন ও মোছার কাজ দুইবার হওয়ার পর তিনবারের সিঁদুর পরস্পরের কপালে থেকে যায়। এইরূপ ‘‘সিপিঁদুর’’ কালে উভয়পক্ষে মহিলারা ‘‘সিপিঁদুর’’-এর গান গেয়ে থাকে। এই গানগুলিতে ঝগড়াটে রূপ শব্দ ব্যবহার হয়ে থাকে। এই সিপিঁদুর গান যেমন -
(ক) সিঁদুর-ই ম্যায়া বয়অ সিঁদুর-ই ম্যা
সিঁদুর-ই ম্যায়া বয়অ সিঁদুর-ই ম্
তালা মলঙর্যা — তালা মলঙ ব্যা
সিঁদুর-ই ম্যা
সিঁদুর-ই ম্যা।
অর্থাৎ সিঁদুর লাগাও হে বালক সিঁদুর লাগাও, মাঝ কপালেতে সিঁদুর লাগাও।
(খ) কাজলই ম্যায়া বয়অ কাজল-ই ম্যা-২
ক্যাড়া ম্যাঃড লুডকুড র্যা-২
কাজল-ই ম্যা
কাজল-ই ম্যা।
অর্থাৎ কাজল লাগাও হে বালক — কাজল লাগাও, মহিষের চোখের ন্যায় চোখে কাজল লাগাও।
(গ) সাকম-ই ম্যায়া বয়অ — সাকম-ই ম্যা-২
চারিঃ সামা বারতি র্যা — চারি সামা বারতি র্যা
সাকম-ই ম্যা। সাকম-ই ম্যা।
এই গানটি বরপক্ষ থেকে গাওয়া হয়েছে ‘‘বয়অ’’ অর্থাৎ বালক উল্লেখ করে। অপর দিকে কনেপক্ষ এই গানেই ‘‘সাঙ্গ’’ অর্থাৎ বালিকা উল্লেখ করে গেয়ে থাকে।
বিবাহে চুমাল ও সিপিঁদুর পর্বই মূলপর্ব। মূলপর্বের কাজ এইভাবে সমাপ্তকরণ করা হয়।
জাটি বকাদল — বিবাহের মূলকার্য সম্পাদনকালে বর ও কনে পক্ষ থেকে যে দুটি তালই আসনরূপে ব্যবহার করা হয়, বিবাহের শেষে সেই তালই দুটির মধ্যে কনেপক্ষের তালই বরপক্ষ এবং বরপক্ষের তালই কনে পক্ষ নিয়ে থাকে। এইরূপ তালই পালটানোকে জাটি বকাদল বলা হয়।
বর-কনিয়াঁ আস্যান — ‘‘বর-কনিয়াঁ আস্যান’’ অর্থাৎ বর-কনেকে নাচানো। বিবাহের মূলপর্ব সমাপ্ত হওয়ার পর বর ও কনে পক্ষের লোকজন কনেকে কাখে করে ও বরকে কাঁধে তুলে নাচের আসরে নিয়ে যায় ও তথায় তাদের দুইজনকে অন্যান্য সকলের সাথে ধামসা-মাদল বাজিয়ে গান করতে করতে নাচানো হয়। বর ও কনেকে নাচানোর সময় যে গান গাওয়া হয় তা উল্লেখ করা যায়, যথা—
(ক) মাঈ চিগা মারাঙাঃ — বয়অ মারাঙাঃ-২
তিরিল ডাঁডাঃ র্যা-২ — জকাকিন প্যা-২।
(খ) মাঈ চিগা উসুলাঃ — বয়অ উসুলা-২
তাআড় দারুত্যা-২ — জকাকিন প্যা-২।
(গ) মাঈ চিগা জুউরাঃ — বয়অ জুউরাঃ-২
বির সাসাঙত্যা-২ — অজঃকিন প্যা-২।
এখানে যথাক্রমে বাংলানুবাদ করে বলা যায়, যা — (ক) বালিকাটি বড়ো — না বালকটি বড়ো, তিরিল নামক ডান্ডা দ্বারা পরিমাপ করো।
(খ) বালিকাটি লম্বা — না বালকটি লম্বা, তালগাছ দ্বারা পরিমাপ করো।
(গ) বালিকাটি উজ্জ্বল — না বালকটি উজ্জ্বল, বন্যহলুদ তাদের গায়ে মাখাও।
কাঁদা মাডি জম — ‘‘কাঁদা মাডি’’ অর্থাৎ কাঁদাসালে রান্না করা ভাত। ‘‘কাঁদা মাডি জম’’ কথার অর্থ এক্ষেত্রে যা বোঝায়, তা হলো নাচের আখড়ায় বর-কনেকে নাচানোর পর বরপক্ষ কাঁদাসালে যে ভাত-তরকারী রান্না করে তা তাদের খাওয়ানো। একই ভাবে যখন বরের বাড়ীর কাদাসালে কনেপক্ষ রান্না করে থাকে, সেক্ষেত্রেও কনেপক্ষ বর-কনেকে রান্নার ভাত খাইয়ে থাকে। একে কাঁদা মাডি জম বলা হয়।
কারকাড ডিআঙ — ‘‘কারকাড’’ কথার অর্থ হলো মাজন বা দাঁত মাজন কাঠি। ‘‘কারকাড ডিআঙ’’ অর্থাৎ এখানে কনেপক্ষের বাড়ীতে বরযাত্রীরা এবং বরপক্ষের বাড়ীতে কনেযাত্রীরা রাত্রি যাপনের পর সকালবেলা দন্ত মাজনের পর উভয়পক্ষ থেকে যে ডিআঙ অর্থাৎ পানীয় মাদক সেবনের জন্য উভয়পক্ষ পেয়ে থাকে, তাই হলো ‘‘কারকাড ডিআঙ’’।
আজি হানার সিম সাঁগার — ‘‘আজি হানার’’ কথার অর্থ হলো বরের দিদিদের সঙ্গে কনের এবং কনের দিদিদের সঙ্গে বরের যে সম্পর্ক, তাই হলো ‘‘আজি হানার’’। ‘‘সিম সাঁগার’’ কথার অর্থ হলো মোরগ বা মুরগী শিকার করা। ‘‘আজি হানার সিম সাঁগার’’ অর্থাৎ বরের বাড়ী চত্বরে কনের দিদিদের জন্য মোরগ বা মুরগী শিকার করা। কনেপক্ষের লোকজন দন্ত মাজন শেষে কারকাড ডিআঙ সেবনের পর কাঁদাসাল থেকে রায়বারের নেতৃত্বে ধামরা-মাদল বাজিয়ে গান গাইতে গাইতে বরের বাড়ীর প্রাঙ্গনে পৌঁছায় এবং বরের বাড়ীর চত্বরে ঘোরাফেরা মোরগ-মুরগীদের চারদিক থেকে ঘিরে ধরে থাকে। এইরূপ ক্ষেত্রকেই ‘‘আজি হানার সিম সাঁগার’’ বলা হয়।
হাডর — ‘‘হাডর’’ কথার অর্থ হলো বিদায়। বর-কনে ও বরযাত্রীদেরকে কনেপক্ষ ধামসা-মাদল বাজিয়ে নাচগান করে জআর তথা প্রণাম বিনিময়ের সাথে বিদায় জানিয়ে থাকে। অপরদিকে বরের বাড়ীতে বরপক্ষ একইভাবে কনেযাত্রীদের বিদায়ের ব্যবস্থা করে।
কাদঅ গাটি — ‘‘কাদঅ গাটি’’ কথার ব্যবহারিক অর্থ বলা যায়, এটা এক প্রকার বিসর্জন। বরের বাড়ী থেকে কনেযাত্রী সকল বিদায়ের পর বরের বাড়ীতে ‘‘কাদঅ গাটি’’ নামক একটা পর্বের কার্যকলাপ শুরু হয়। এই ক্রিয়াকলাপ সম্পাদনের প্রধান দায়িত্বে থাকে একজন মহিলা যে বরের সঙ্গে বৌদি সম্পর্কে সম্পর্কিত। মহিলাটি বিবাহে ব্যবহৃত সমগ্র উপকরণ বা উপকরণের অংশাদি, যথা — ফুল, ফুলের মালা বা তার ছিন্নাংশ, তেল-হলুদ রাখার পাতার পাত্র ইত্যাদি গুছিয়ে গাছিয়ে কোন একটা আধারে আধারিত করে। তারপর উক্ত মহিলা উপকরণ আধারিত পাত্রটি নিজ মাথায় নিয়ে বর ও কনেকে সঙ্গে করে কোন নদী বা পুকুরের উদ্দেশ্যে রওনা দেয়। এইসময় কনের হাতে থাকে একটি কাঁসার ঘটি ও বরের হাতে থাকে ধনুক ও তিনটি তির। এই মহিলা ও বর-কনের গমনের পথে সঙ্গ দিয়ে থাকে বরের বাড়ীর আত্মীয়-স্বজন ও কুটুম্বরা। সকলে নদী বা পুকুরের জলের ধারে পৌঁছে তথায় বর-কনের দ্বারা পূজা-পাশা করা হয়। পূজা-পাশান্তে মহিলাটি উপকরণ সামগ্রী জলে ভাসিয়ে দেয়। এরপর বর-কনে ও আত্মীয়-স্বজনরা পুকুরের জলে স্নান করে নেয়। এইরূপ স্নানের সময় কনের হাতের ঘটি আত্মীয়-স্বজনেরা ছিনিয়ে নিয়ে ঘটি লুকানোর লুকোচুরি খেলাও করে থাকে। অবশেষে কনে পুকুর থেকে এক ঘটি জল নিয়ে মাথায় তুলে নেয় ও সেই ঘটির জলের মধ্যে তিরের ফলা ডুবিয়ে রাখে। বরের হাতে কেবলমাত্র ধনুক থাকে। বাড়ীর অভিমুখে রওনার শুরুতে বরটি কনের মাথার ঘটির জলে ডুবানো একটি তির নিয়ে ধনুকের মাধ্যমে সামনে দিয়ে ছুঁড়ে থাকে, আর তা কুড়াবার জন্য কনে সামনের দিকে এগিয়ে যায় এবং তির কুড়িয়ে আবার মাথার ঘটির জলের মধ্যে রেখে দেয়। এইভাবে বর-কনে বারংবার তির ছোড়া ও কুড়ানোর মধ্য দিয়ে বর-কনে ও অন্যান্য সকলে বাড়ীর দিকে ক্রমশ এগিয়ে যেতে থাকে। সর্বশেষে বাড়ী পৌঁছালে বর ও কনে একটা নির্দিষ্ট স্থানে ঘটির জল রেখে দিয়ে ‘‘কাদঅ গাটি’’-এর একটি অংশকে সমাপ্তকরণ করে। ‘‘কাদঅ গাটি’’-এর এই অংশকে ‘উনুম-ইনুঙ’ বা সংক্ষেপে ‘উনুমিনুঙ’ বলা হয়। সর্বশেষ অংশের নাম হলো ‘কাটা আবুঙ বাড’।
কাটা আবুঙ বাড — ‘‘কাটা আবুঙ বাড’’ অর্থাৎ পদ ধৌতকরণ। এখানে ‘‘কাটা আবুঙ বাড’’ কথায় এইরূপ অর্থ প্রকাশ করা যায়, যা ‘‘কাদঅ গাটি’’ পর্বের ‘‘উনুমিনুঙ’’ অনুপর্বে পুকুর থেকে আনিত ঘটির জলে বর-কনের দ্বারা আত্মীয়-স্বজন ও কুটুম্বগণের পদ ধৌতকরণের ব্যবস্থা করা হয়। এইরূপ পদধৌতকরণ কার্য্য কনে করে থাকে এবং বর সহযোগিতা দিয়ে থাকে। পদধৌতকরণ কার্য্যকালে কনে এক-এক করে প্রত্যেক ব্যক্তির নিকট থেকে টাকা ও গহনা ইত্যাদি আদায় করে থাকে। বর ও কনের ক্ষেত্রে এটা একরূপ উপহার গ্রহণ যা আদি থেকে কোল সমাজ অভ্যন্তর প্রচলন রয়েছে।
দুআর এ্যাস্যাড-ক্যাস্যাড বাড — ‘‘দুআর এ্যাস্যাড’’ অর্থাৎ দুয়ার বা দুয়ারের দরজা বন্ধ করা। ‘‘ক্যাস্যাড’’ কথার অর্থ হলো দরজা বন্ধ বা দরজা জাতীয় কোন কিছুর বন্ধ দ্বারা বাধাপ্রাপ্ত হওয়া। বিবাহক্ষেত্রে প্রথম যখন বর ও কনে একত্রে বরের বাড়ীতে প্রবেশ করতে যায়, তখন বরের বোন ও দিদি সকল বাড়ীর দরজা বন্ধ করে বর-কনের প্রবেশে বাধা সৃষ্ট করে থাকে। এইক্ষেত্রে বোন ও দিদির কার্য্য হলো এ্যাস্যাড এবং বর-কনের ক্ষেত্রে প্রবেশ পথের প্রতিবন্ধকতা হলো ক্যাস্যাড। বরের বোন ও দিদিরা বাড়ীর দরজা বন্ধ করে — বরের নিকট থেকে কোন কিছু একটা আদায় করে — তবেই তারা বাড়ীর দরজা উন্মুক্ত করে থাকে। এইরূপ ক্ষেত্রকেই ‘‘দুআর এ্যাস্যাড-ক্যাস্যাড বাড’’ বলা হয়।
কিমিন বাড — ‘‘কিমিন’’ কথার অর্থ হলো বধূ। ‘‘কিমিন বাড’’ অর্থাৎ নতুন বাড়ীতে কিছু আদায়ের উদ্দেশ্যে নববধূর নীরব বায়না। নতুন বাড়ীতে নববধূ তার বায়নার আদল রূপে আচরণে যা প্রকাশ করে থাকে — তা হলো সে বাড়ীর কোন কাজ করতে চায় না, কখনো এখানে — কখনো ওখানে অভিমান রূপ নীরব ভূমিকা পালন করে থাকে। এইরূপ পরিস্থিতির উপর ভিত্তি করে বাড়ীর যে কেহ বড়রা নববধূর নীরব বায়না ভঙ্গের জন্য এগিয়ে আসে এবং অলংকার বা কিছু একটা প্রদান করে থাকে বা প্রদানের জন্য প্রতিশ্রুতি দিয়ে থাকে। এইরূপে কোন কিছু প্রদান বা প্রতিশ্রুতিতে নববধূ সন্তুষ্টি বোধ করলে সে তার মনের অবস্থান বদল করে।
পারিদি — ‘‘পারিদি’’ কথার আক্ষরিক অর্থ হলো স্থান বদল। ব্যবহারিক অর্থে বাংলা ভাষায় ‘‘ফেরতি’’ কথার সমরূপ। বর-কনে যখন একদিকে জামাতা — অপরদিকে পুত্রবধূ তখন এই পরিচয় নিয়েই বিবাহের পাঁচ কিম্বা সাত দিনের মাথায় পুত্রবধূর বাবার বাড়ীতে নবদম্পতি প্রথম গমন করে থাকে। এই ক্ষেত্রকেই পারিদি অর্থাৎ ফেরতি বলা হয়।
আরা বাড — ‘‘আরা’’ শব্দের অর্থ জামাতা। এই আরা তথা জামাতা পারিদি তথা ফেরতি-এর দিনে শ্বশুরালয়ে পৌঁছে অভিমান করে প্রথমে অন্ন বা জল স্পর্শ করতে চায় না। এক্ষেত্রেও শ্বশুরালয় থেকে একটা কিছু দিয়ে জামাতার অভিমান ভঙ্গ করা হয়ে থাকে।
কোল সমাজ অভ্যন্তর ‘‘দুআর ইতুড সিঁদুর’’ ও ‘‘টুংকী দিপিল’’ বিবাহ ছাড়াও যুবক-যুবতীর মধ্যে জীবনসঙ্গী ও সঙ্গিনী রূপে মিলিত হওয়ার ক্ষেত্রে আরও কয়েকটি পন্থাকে কোল সমাজ আদি থেকে বিবাহরূপে স্বীকৃতি দিয়েছে। এই পন্থা বা বিবাহগুলিকে পর্য্যায়ক্রমে সংক্ষেপে আলোচনা করা যাক।
অপর তিপিই আআঁদি — ‘অপর’ কথার অর্থ হলো টানাটানি এবং ‘‘তিপিই’’ কথার অর্থ হলো হাতাহাতি। ‘‘অপর তিপিই আআঁদি’’ অর্থাৎ এখানে এক কথায় বলা যায় বলপ্রয়োগপূর্ব্বক বিবাহ। আর এক রূপে এর অর্থ প্রকাশ করা যায়, ‘‘হরণ ভিত্তিক বিবাহ’’। আদিতে হরণভিত্তিক বিবাহ শুরু হয়েছিল নারীকুল থেকেই। কোন এক নারীর সাথে বিবাহ করানোর উদ্দেশ্যে জোটবদ্ধ নারীরা কোন এক পুরুষকে হরণ করতো। পুরুষকে হরণ কালে বিবাহ ইচ্ছুক নারীটি পুরুষের কপালে ও হাঁটুতে সিঁদুর ঘষে চিহ্নিত করে বিবাহ করতো। পরবর্তীকালে কোন এক পুরুষের জন্য জোটবদ্ধ পুরুষরা কোন একটি নারীকে হরণ করে বিবাহ করার প্রচলন কোল সমাজে শুরু হয়েছিল, যা বর্তমান অবধি কিছু কিছু এলাকায় রয়েছে। পুরুষ দ্বারা নারীহরণকালে বিবাহ ইচ্ছুক পুরুষটি নারীর কপালে সিঁদুর ঘষে থাকে। নারী বা পুরুষ হরণকালে পরস্পরে আঘাতজনিত রক্তক্ষয়ও হতো। এইরূপ হরণ করে বিবাহ করার ক্ষেত্রকে ‘‘অপর তিপিই আআঁদি’’ বলা হয়, যাকে কোল সমাজ বিবাহরূপে স্বীকৃতি দিয়ে এসেছে।
সাসাঙ উঁরা আআঁদি — ‘‘সাসাঙ’’ কথার অর্থ হলো হলুদ এবং উঁরা কথার অর্থ হলো দেহ। ‘‘সাসাঙ উঁরা আআঁদি’’ অর্থাৎ বিবাহের ক্ষেত্রে যে বিভিন্ন পর্বগুলি রয়েছে, সেগুলি ব্যতীত কেবলমাত্র গায়ে তেল-হলুদ মাখিয়েই বিবাহকার্য্য সম্পাদন করা। ‘‘সাসাঙ উঁরা আআঁদি’’ হলো প্রায় ‘‘অপর তিপিই আআঁদি’’-এর মতো। এই ক্ষেত্রে কোন যুবতী তার কি ঘটতে চলেছে, তা আগাম জানতে পারে না। কোল সমাজ অভ্যন্তর কোন এক যুবক একাকিত্ব বসবাস করছে, অথচ নানান অসুবিধা হওয়া সত্ত্বেও বিবাহের নামগন্ধ ধরছে না। এমন মানুষটির যাতে কোনরূপ বিবাহ হয়, সেই উদ্দেশ্যে তার আত্মীয়-স্বজনরা উদ্যোগ গ্রহণ করে থাকে। এইরূপ উদ্দেশ্য এবং উদ্যোগের মধ্য দিয়ে আত্মীয়-স্বজনেরা এমন এক যুবতীর সন্ধান চালায় — যে বাড়ীর লোক দ্বারা পীড়িত হচ্ছে, বা যুবতীকে বিবাহকরণের জন্য বাড়ীর লোকের ঘুম ভাঙ্গছে না। এইরূপ যুবতীকে যে কোন পন্থা অবলম্বন করে যুবকের বাড়ীতে আনিত হয় ও যুবকের সাথে যুবতীকে তেল-হলুদ মাখিয়ে বিবাহ সম্পাদন করা হয়ে থাকে। এইরূপ ঘটনার খবর যুবতীর বাড়ীতে পৌঁছালে, বাড়ীর লোকেরা যুবকের আত্মীয়-স্বজনদের সঙ্গে আলাপ-আলোচনার মাধ্যমে ‘গনঙ’ অর্থাৎ পণ বিষয়ক ব্যাপারে একটা সিদ্ধান্ত হয়ে থাকে এবং ওই সিদ্ধান্ত অনুযায়ী যুবকপক্ষ কনের মা-বাবাকে ‘পণ’ প্রদান করে থাকে। আবার অনেক সময় যুবতীর বাড়ীর লোক এইরূপ বিবাহ মেনে নিতে না পারা যুবতীকে বাড়ী ফিরিয়ে নিয়ে চলে যায়।
সানাঙ সাপানাঙ আআঁদি — ‘‘সানাঙ সাপানাঙ আআঁদি’’ অর্থাৎ কোন যুবক-যুবতী পরস্পরের ভাব-ভালোবাসার উপর ভিত্তি করে উভয়পক্ষের অভিভাবকদের না জানিয়ে, কেবলমাত্র পরস্পরের উপর আস্থা-ভরসা রেখে বিবাহ করা। এইরূপ বিবাহকে কোল সমাজ সামাজিক রূপে স্বীকৃতি দিয়ে থাকে। ‘‘সানাঙ সাপানাঙ আআঁদি’’-কে ‘‘ক্যায়া-ক্যাপ্যায়া আআঁদি’’-ও বলা হয়।
আনাদ্যার আআঁদি — ‘‘আনাদ্যার আআঁদি’’ তথা আনাদ্যার বিবাহের ক্ষেত্র সম্পূর্ণ রূপে প্রস্তুত হয় — কোন এক যুবতীর প্রচেষ্টায়। অনেক সময় কোল সমাজ অভ্যন্তরের কোন কোন যুবতীকে দেখা যায়, তাদের পাড়াপ্রতিবেশী বা গ্রামের কোন পরিবারের কোন যুবককে পছন্দ করে থাকে, তবে তারা বিবাহের উদ্দেশ্যে সেই যুবকের পরিবারের প্রতি দিনের পর দিন কালে অকালে লাগাতার সময় ব্যয় করে থাকে। এইরূপ ক্ষেত্রে কোন এক যুবতী যুবকের বাড়ীতে গিয়ে বাড়ীর লোকের সঙ্গে হাসি-খুশিতে কথা বলে থাকে। যুবতীর মুখে যত না কথা — তার চেয়েও বেশী উক্ত পরিবারে সর্বপ্রকার কাজে সহযোগিতা করে থাকে। যুবকের পরিবারের সঙ্গে দীর্ঘ মেলামেশা ও জড়িত থাকার বিষয়ে যুবতীটি পাড়াপ্রতিবেশী ও গ্রামের লোকের দৃষ্টি আকর্ষণ করে থাকে। গ্রামের লোকের এইরূপ দৃষ্টি আকর্ষণ ধীরে ধীরে যুবতীটির ভবিষ্যৎ রক্ষার ভিত গড়ে তোলে। একসময় পাড়াপ্রতিবেশী ও গ্রামের লোকেরা যুবতীটির জন্য এগিয়ে আসে। কারণ, উক্ত পরিবারের সঙ্গে যুবতীটির দীর্ঘ মেলামেশা ও জড়িত থাকার বিষয়টি যুবতীটিকে আর অন্য কোথাও বিবাহ প্রদানের ক্ষেত্রে বাধ সাধবে। তাই, পাড়াপ্রতিবেশী ও গ্রামের লোকেরা যুবতীটির সঙ্গে ওই পরিবারের যুবককে বিবাহ করাতে বাধ্য করায়। এইক্ষেত্রের এই বিবাহকে আনাদ্যার আআঁদি বলা হয়।
স্যাতা ডাটা আআঁদি — কোল সমাজে আর এক প্রকার বিবাহ রয়েছে, যা নারীর সঙ্গে পুরুষ বা পুরুষের সঙ্গে নারীর বিবাহ নয়। এই বিবাহ বাধা বা ফাঁড়া খণ্ডন করার বিবাহ। কোল সমাজ অভ্যন্তর কোন শিশুর জন্মের পর যদি তার দুটি চোয়ালের মধ্যে উপর চোয়াল তথা উপরের দাঁত পাটিতে দাঁত প্রথমে জন্মায়, তখন সেই দাঁত বা দাঁতগুলিকে ‘ফাঁড়া’ বা বাধাযুক্ত দাঁত হিসাবে কোল সমাজ গণ্য করে থাকে। এই দাঁতকে কোল ভাষায় ‘‘স্যাতা ডাটা’’ অর্থাৎ কুকুরের দাঁত বলা হয়। ‘‘স্যাতা ডাটা’’-যুক্ত শিশুর বাধা বা ফাঁড়া খন্ডনের উদ্দেশ্যে পুরুষ শিশুকে নারী কুকুর এবং কন্যা শিশুকে পুরুষ কুকুরের সাথে বিবাহকরণ করা হয়ে থাকে। তাছাড়া শাবড়া গাছের সঙ্গেও বিবাহকরণের রীতি রয়েছে। এই বিবাহকে ‘‘স্যাতা ডাটা আআঁদি’’ বলা হয়।
কোল তথা হো সমাজের বিবাহ বিষয়ের আলোচনা সংক্ষেপে আলোচিত হলো। তবুও এই বিষয়ে আর একটুখানি বলে রাখা দরকার যা কোল জাতির মানুষ আদি থেকে বিস্তার লাভ করতে করতে বর্তমান অবধি ভারতে বিভিন্ন রাজ্য ছাড়াও আন্তর্জাতিক ক্ষেত্রের বিভিন্ন দেশের বিভিন্ন পরিবেশে বসবাস করছে। এইরূপ বিভিন্ন পরিবেশে থাকা কোল সমাজের বুকে ক্রমে নানান পরিবর্তন এসেছে — তাতে কোন সন্দেহ নেই। এইরূপ হিসাবে বিবাহ রীতির ক্ষেত্রে এক অঞ্চলের বিবাহের সাথে আর এক অঞ্চলের বিবাহ রীতির পার্থক্য থাকতেই পারে। এইরূপ পার্থক্যকে ভিত করে কোল জাতিগত ভিতে পার্থক্য রয়েছে — এইরূপ ভাববার কোন অবকাশও নেই।